ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি’র ২৬/১১/২০১৭ গণ-কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ :

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , ,





ন্দোলন কর্মসূচী
(ক) নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহের ভিত্তিতে আসামের বিভিন্ন জেলায় কনভেনশন করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখা।
(
খ) নিম্নলিখিত দাবিসনদের ভিত্তিতে বরাকের তিন জেলায় ন্যূনতম একটি করে জনসভা করা এবং ডিসেম্বরের শেষে কোরাসের উদ্যোগে বরাক উপত্যকা পরিক্রমায় কনভেনশনের সিদ্ধান্ত সমূহ প্রচার করা।
(
গ) শুধুমাত্র এইচপিসি-র বিষয় নিয়ে ও নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আলোচনার জন্য অনতিবিলম্বে ফোরামের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ সভা ডাকা হবে। এই সভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানায় কনভেনশন।
(
ঘ) বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করে মানুষের মধ্যে এনআরসি-ভীতি দূর করা ও তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আইনজীবীদের পরামর্শ উপস্থাপন করা। নাগরিকদের হেনস্তা থেকে বাঁচাতে আইনি সহায়তা প্রদান।
                                             ~~~০০০~~~
নীতিগত প্রস্তাবসমূহ
(১) এনআরসি ও নাগরিকত্বের বিষয়ে :
এনআরসি প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, তখন বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা একে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন এই ভেবে যে স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায় থেকে আসামে নাগরিকত্বের প্রশ্নকে ঝুলিয়ে রেখে ভারতীয় নাগরিকদের হয়রানি ও এনিয়ে রাজনীতির দুষ্টচক্রের যে দীর্ঘ খেলা চলে আসছে তার হয়ত এক স্থায়ী সমাধান হবে। কিন্তু বারবার নাগরিকত্ব প্রমাণের মানদণ্ড বদলে দিয়ে এনআরসি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলা হচ্ছে ও ভারতীয় নাগরিকদের হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। এনআরসি প্রক্রিয়া নিজেই এক বিভ্রান্তি ও ভীতির বাতাবরণ তৈরি করেছে। নাগরিকত্বের প্রশ্নকে আমরা মানবিক ও সাংবিধানিক অধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে আগ্রহী। যেহেতু ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ মধ্যরাত্রি ডেটলাইন হিসেবে সব পক্ষ মেনে নিয়েছে, নাগরিকত্ব প্রশ্নের স্থায়ী সমাধানের স্বার্থে আমরাও তাই মেনে নিচ্ছি। নাগরিক পরিচয়ের প্রশ্নে আর কোনো ধরনের বেঞ্চমার্কের আমরা বিরোধী। বারবার পদ্ধতি ও প্রমাণপত্রের মানদণ্ড বদল করে ভারতীয় নাগরিকদের হয়রানি বন্ধ করা,উপর্যুপরি বন্যা নদী-ভাঙন ইত্যাদিতে সর্বস্বান্তদের প্রমাণপত্র দাখিলের ব্যাপারে যথেষ্ট নমনীয় পদ্ধতিতে মানবিকতার সাথে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা ও এনআরসি যেহেতু নাগরিক চিহ্নিত করবে, তাই ডি-ভোটার ও ডিটেনশন ক্যাম্প উঠিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা উত্থাপন করছি।
(২) বিশ্বায়ন, বেসরকারিকরণ ও শ্রমজীবীদের অধিকার :
আমাদের চোখের সামনে বরাক উপত্যকার একটি বৃহৎ শিল্পোদ্যোগ এইচপিসি বন্ধ হয়ে গেল। দুর্নীতি অছিলা মাত্র, আসলে গোটা দেশব্যাপী বেসরকারিকরণের যে আয়োজন চলছে এ তারই পরিণতি। শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন দেওয়ার মতো মানবিক আচরণটুকুও সরকার দেখাল না। সমস্ত সরকারি উদ্যোগকে ব্যক্তি-মালিকানায় দিয়ে দেওয়া, বিদেশি পুঁজির লুণ্ঠনের জন্য শ্রম ও বিত্তীয় সংস্কার, কৃষি বিপর্যয়, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় শিল্পে বিনিয়োগে অনীহা ইত্যাদি সবকিছু মিলে ভয়ানক রুজি-রোজগার ও বেকারত্বের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। চা-শ্রমিক, পরিবহণ শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ি আশা কর্মী, ক্ষুদ্রশিল্পের শ্রমিক, ক্যাজুয়্যাল ও ঠিকা শ্রমিক ইত্যাদি সবাই ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। সরকার তাদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে প্রচলিত আইনগুলিই বদলে দিতে চাইছে। শ্রমিকদের মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষার ন্যায্য অধিকার ও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানায় শিল্পায়নের প্রয়োজন।
(৩) দেশপ্রেম ও উন্নয়ন:
দেশ শুধুমাত্র এক ভূগোল নয়, এই ভূগোলে বসবাসকারী মানুষকে বোঝায়। এই মানুষকে ভালবাসার নামই দেশপ্রেম। মানুষের প্রতি ভালবাসা ব্যক্ত হয়ে উঠে সবচাইতে নিপীড়িত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণি-বর্ণ-জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের এক দেশব্যাপী ধারণার মধ্য দিয়ে। দেশকে ভূগোল ও সীমানা রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এই বঞ্চিত মানুষরা থেকে যায় আড়ালে, তাদের উপর নিপীড়ন পায় বৈধতা। এই বৈধতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিপীড়িতের পক্ষে যারা বৌদ্ধিক চর্চা করেন বা সমাজ কর্মী হয়ে উঠেন তাদের উপর নেমে আসে আক্রমণ। দেশপ্রেমের নামে এই আক্রমণের ইতিমধ্যে বলি হয়েছেন বেশ কজন বুদ্ধিজীবী ও দলিত-সংখ্যালঘু মেহনতি মানুষ। এই কল্পিত দেশপ্রেমের বিপরীতে প্রকৃত দেশপ্রেমকে রক্ষা করার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই দেশপ্রেম প্রোথিত থাকবে এমন এক উন্নয়ন মডেলে যা ভারতবর্ষের শ্রম ও প্রকৃতিকে ধ্বংসাত্মকভাবে শোষণ করে না।
(৪) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য :
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সংকট দেখা দিচ্ছে ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক অসাম্য ও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি পুঁজির প্রাধান্যের ফলে। ভাল শিক্ষা ও ভাল চিকিৎসা হয়ে পড়ছে ব্যয়বহুল। সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে মুনাফার লক্ষ্য হয়ে পড়েছে প্রধান। শিক্ষায় সরকারি ব্যয় হয়ে পড়ছে সংকুচিত, ফলে মাতৃভাষায় পঠন পাঠনের সুযোগও হারিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ভয়ানক বিপর্যয়ের হাতছানি শোনা যাচ্ছে। আমেরিকান ধনকুবের জর্জ সরস ও বিল গ্যাটস স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন খুলেছেন এবং ফাউন্ডেশনের অর্থ নিয়ে ইতিমধ্যে ভারতে হাজির হয়েছেন। চিকিৎসা ব্যবসায়ের মাধ্যমে বেসরকারিকরণ ও মুনাফাই যে তাদের প্রধান লক্ষ্য এব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সংগ্রামকে জোরদার করা আজকের সময়ের দাবি।
(৫) বৈচিত্র্যের উপর আঘাত ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা :
বৈচিত্র্যের উপর আঘাত আজকের ভারতবর্ষে এক প্রধান বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এক ভাষা-এক ধর্ম-এক সংস্কৃতির প্রচারের রাষ্ট্রীয় আয়োজনের পেছনে চলছে ক্ষমতার ও বাজারের কেন্দ্রীভবন। দিল্লি থেকে গোটা ভারতবর্ষ শাসন করার মনোবাসনা পূর্ণ করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের জিগির তোলা হচ্ছে, রাজ্যকে করে দেওয়া হচ্ছে পঙ্গু, যারা এখনও ভাষিক-সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বহুত্ববাদের বিপরীতে একমত ও একপথের এই শাসন কায়েম করার মানসিকতা অন্তর্বস্তুতে ফ্যাসিস্ট চরিত্রের। এই বিপদকে আমাদের রুখতে হবে।
_______________________________________
নির্দিষ্ট প্রস্তাবসমূহ :
(১) প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী অবিলম্বে ডিটেনশন ক্যাম্পউঠিয়ে দিতে হবে। (২) এনআরসি যেহেতু নাগরিকত্ব নির্ধারণ করবে, তাই ডি-ভোটারউঠিয়ে দিয়ে নাগরিকদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। (৩) ১৯৭১র ২৪ মার্চের মধ্যরাত্রির আগে আসামে বসবাসকারীদের নাগরিকত্ব দিতে হবে কোনো শ্রেণি বিভাগ ছাড়া। (৪) পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ১৯৬৬র ভোটার তালিকাকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করা ও সরকারি অফিসারকে সামনে রেখে পুলিশ ভ্যারিফিকেশন করার প্রক্রিয়াকে ফোরাম বিরোধিতা করছে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ যেহেতু নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষ এবং পুলিশ প্রশাসন নিজেই যেহেতু সরকারি বিভাগ, তাই উপরোক্ত নিয়ম বাতিল করা। (৫) এইচপিসি কর্মীদের বকেয়া বেতন অবিলম্বে প্রদান করতে হবে। (৬) সরকারি উদ্যোগে এইচপিসি চালু করতে হবে। (৭) নদী-ভাঙন রোধ করতে হবে। (৮) সম-কাজে সম-মজুরি প্রদান ও চা-শ্রমিক সহ সব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আইনের অধীনে ন্যূনতম মজুরি প্রদান করতে হবে। (৯) সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করা এবং এসব ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ বন্ধ করা। (১০) উচ্চশিক্ষায় ভর্তি ও অন্যান্য মাশুলের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি রোধ করে পূর্বাবস্থায় নিয়ে যাওয়া। (১১) সবার মাতৃভাষায় পঠনপাঠন ও ভাষিক-সাংস্কৃতিক অধিকার সুনিশ্চিত করা। (১২) ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করা। (১৩) ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ইত্যাদির পরিসেবা সহ উক্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের জমির স্থায়ী পাট্টা প্রদানের দাবিতে উদ্যোগ নেওয়া। (১৪) শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুল কলেজে বৈজ্ঞানিক অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার এবং বরাকের নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার করতে হবে।(১৫) চা-বাগানের যুবক-যুবতীদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরির জন্য সংগ্রাম করা, চা-বাগানের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশের জন্য উদ্যোগ নেওয়া। চা-শ্রমিকদের মজুরি ৩৫০টাকা বৃদ্ধি করার দাবি জানানো। নিজ মাতৃভাষায় চা-শ্রমিকদের পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রদান চালু করার দাবি জানানো। সংগঠনের কাজ করার ক্ষেত্রে বাগান কর্তৃপক্ষ যে বাধা দেয় ও কূটচালের আশ্রয় নেয় তার মোকাবিলা করা। (১৬) নদী-উপনদীগুলোর জলে কোয়ারিগুলোর যানবাহনের মাধ্যমে পেট্রোল-ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে। এই জলগুলোই চা-বাগান সংলগ্ন এলাকাগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে, ফলে এই এলাকাগুলোর মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে বিভিন্নধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। জল-দূষণের বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া।(১৭) চা-শ্রমিক ও প্রাক্তন চা-শ্রমিকদের তপসিলি জাতি-জনজাতির স্বীকৃতি দেওয়া ও চা-শ্রমিক ও প্রাক্তন-শ্রমিকদের জমির পাট্টা প্রদান। (১৮) শিলচর মেডিক্যাল কলেজের বিভিন্ন বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রে যেভাবে বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে তার বিরোধিতা করা। (১৯) শিলচর মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগকে আধুনিক সরঞ্জাম, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভাগে রূপান্তরিত করতে হবে। (২০) সাম্প্রদায়িক বিভাজনের জন্য সচেষ্ট থাকা দুষ্টচক্রদের চিহ্নিত করা, ইতিহাস বিকৃত করার ও ঘৃণার বাতাবরণ তৈরির অপচেষ্টা সম্পর্কে সচেতন থাকা ও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন