“মিঁয়া লাইফ ম্যাটারস”
Posted by
“মিঁয়া লাইফ ম্যাটারস”
মিঁয়া শব্দ নাকি অপমানজনক
শব্দ। আমেরিকা ইউরোপে ব্ল্যাক, নিগার এগুলোও অপমানজনক শব্দ। কিন্তু ইতিহাসের
পরিহাস এই যে কখনও কখনও জনগোষ্ঠীয় অপমানসূচক শব্দও ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারসে’র মতো
সামাজিক সম্মান আদায়ে বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠে। চরম অপমান, অত্যাচার, ঘৃণা ও
গণহত্যার ইতিহাসের চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার এক সুতীব্র আকাঙ্খা এবারের এই
‘মিঁয়া’ শব্দের সচেতন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে। এর পরিণতি কী এখনই বলা
মুস্কিল। কিছু স্বার্ত্থান্বেষী মানুষ একে ভাষার বিতর্কে জড়িয়ে বিপথে পরিচালিত
করতে সচেষ্ট।
অসমে ‘মিয়া ভাষা’ নিয়ে এক
নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা কী হবে, সেটা শেষ বিচারে নির্ধারণ
করার অধিকার একমাত্র সেই নির্দ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর, এ নিয়ে গণতান্ত্রিক বিতর্ক
নিশ্চয়ই চলতে পারে। সেই নির্দ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী তাদের মুখের ভাষাকে কোনো লেখ্য মান্য
ভাষার অধীন হিসাবে দেখবে, না নিজেদের মুখের ভাষাকে এক নতুন লেখ্য ভাষা হিসাবে
বিকশিত করবে সে স্বাধীনতা সম্পূর্ণতই সেই ভাষা-ব্যবহারকারীদের। তারা কোন লিপি
ব্যবহার করবে, কীভাবে সাহিত্য সৃষ্টি করবে সে স্বাধীনতাও তাদের নিজেদের – এটাই গণতান্ত্রিক
নীতি।
তবে ভাষিক আত্মীকরণের
মাধ্যমে এক বৃহত্তর জাতি গঠন সামাজিক বিপ্লবের জন্য উপযোগী। মিসেল ফুঁকো যেমনি
ভাষার সাথে ক্ষমতা ও আধিপত্যের সম্পর্ককে দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি আধিপত্যকারী শ্রেণি
বলপূর্বক সবাইকে নিজ ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সামিল করে নিতে পারে। আবার সেই শ্রেণি যদি এতে
অক্ষম হয়, তখন কোনো জনগোষ্ঠী সেই ভাষিক আধিপত্য থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে
স্বতন্ত্র পথ ধরতে পারে। আরেকটি পথ রয়েছে, সেটি হচ্ছে কোন ভাষিক পরিচিতির পথে না
হেঁটে সোজাসুজি সামাজিক বিপ্লবের পথে হাঁটা, সেই পথটি প্রলেতারীয় পথ এবং সেই পথ
এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি। সেই প্রলেতারীয় পথের সন্ধানে এই ‘মিঁয়া বিদ্রোহ’ শক্তি
যোগাতে পারে।
যখনই কোন আলোড়ন সৃষ্টি হয়,
তখনই একে বিপথে পরিচালিত করার জন্য শাসকশ্রেণি ময়দানে নেমে পড়ে এবং তারা নিপীড়িত ও
নিপীড়ক সব জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই সুযোগসন্ধানীদের জুটিয়ে ফেলতে সক্ষম। আধুনিক
পৃথিবীর ইতিহাস থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে পুঁজিবাদ এমন এক ব্যবস্থা যা
সবধরনের সামাজিক শক্তি বা আন্দোলনকেই ব্যবহার করতে পারে – আত্মস্থ করে নিতে পারে,
শুধু শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনকে পর্যুদস্ত না করে নিজেকে
বাঁচাতে পারে না। কিন্তু অসমে কিছুসংখ্যক মার্ক্সবাদী যাদের কেউ কেউ সম্প্রতি
জাতীয়তাবাদী এমনকি উগ্রজাতীয়াতাবাদী হয়ে উঠেছেন, তাঁরা সবাইকে শাসকশ্রেণির
চক্রান্তের জুজুর ভয় দেখিয়ে নিপীড়িতের গণ-সক্রিয়তাকে দমন করতে উদগ্রীব। সব পথ যখন
বন্ধ হয়ে যায় তখন যে কোনো গণ-সক্রিয়তাই শাসক শ্রেণির কাছে আত্মসমর্পণ করে।
ফ্যাসিবাদের দোহাই দিয়ে যারা ‘মিঁয়া বিদ্রোহকে’ অবজ্ঞা করছেন, তারা এটা জানেন না
যে পুঁজিবাদ যেহেতু সবকিছুকে ব্যবহার করতে পারে, তাই ফ্যাসিবাদীরাও পারে –
ফ্যাসিবাদ তো পুঁজিবাদী শাসনেরই একটি রূপ।
যে মার্কস তাঁর গোটা জীবন
ধরে ‘নিউ প্যাসন অ্যাণ্ড নিউ ফোর্সের’ সন্ধান করে গেলেন, যে মার্কস প্যারিস
বিদ্রোহ দেখে বলতে পারেন শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র কী হবে তা আবিষ্কৃত হয়েছে, সেই
মার্ক্সবাদকে অসমের এই বামপন্থীরা পর্যবসিত করলেন চক্রান্তের তত্ত্বে। কোন
মানসিকতায় আক্রান্ত হয়ে তাঁরা মিঁয়া কবিতায় আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের
অন্তর্বস্তু দেখতে পান না? এই সংগ্রাম পরাজিত হবে, না বিজয় অর্জন করবে – সে ভিন্ন
প্রশ্ন। ফরাসি বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লব সর্বত্রই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মোক্ষম আঘাতই
পর্যুদস্ত হয়েছে, তাতে কী বিপ্লবী সক্রিয়তা কোনো অংশে খাটো হয়ে যায়?
আত্মগ্লানি থেকে মুক্তির পথ
সমাজ বিপ্লবের পথকে উন্মোচিত করে। আর বর্তমান ভারতে সব জাতীয়তাবাদী আধিপত্যই ভাষা
ও জাতির বিকাশের পরিপন্থী, এই পথ সামূহিক অধঃপতনের পথ।
“মিয়া লাইফ ম্যাটারস”
আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক এবং সেটা শুধু ভাষার লড়াই নয় – স্থিতাবস্থা ভাঙতে ‘নিউ
প্যাসন অ্যাণ্ড নিউ ফোর্সের’ সন্ধান দিক – জাগ্রত মানুষ মেহনতি মানুষের ঐক্য গড়ে
তুলুক।
0 comments:
Post a Comment