বামপন্থী নির্জীবতা
Posted by
বামপন্থী নির্জীবতা
অরূপ বৈশ্য
গণতান্ত্রিক পরিসরের বিস্তৃতির জন্য বামপন্থী রাজনীতির সবল
উপস্থিতি জরুরি। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি কী আবারও মাথা তুলে দাঁড়াবে? সেই
প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র এক বিষয়ীগত প্রচেষ্টার মধ্যে নিহিত নয়, এই প্রচেষ্টা
কীভাবে হবে সেটাও গুরুত্ত্বপূর্ণ। এ এমন একধরনের বিষয়ী বা সমাজ-সংগঠক যারা সমাজের
গতিশীলতার অভ্যন্তরে ‘নতুন প্যাশন ও নতুন শক্তি’র উত্থানের লক্ষ্যে ক্রিয়াশীল
থাকে। এরা এমন একধরনের সংগঠক যারা গণ-সক্রিয়তার অভ্যন্তরে প্রগতিশীল শক্তিকে সামনের সারিতে চলে আসার মদত দেয় ও এই শক্তির নেতৃত্ব দেয়। এরা এমন একধরনের সংগঠক যারা
আধুনিকতাকে স্বীকৃতি দেয়, আবার প্রতিটি সন্ধিক্ষনে আধুনিকতার নতুন রূপের নির্মাণে
ব্রতী হয়। আজকের ভারতীয় বামপন্থী চিন্তাচর্চায় দলীয় আধিপত্যের প্রশ্নটি প্রধান
বিচার্য বিষয় হয়ে উঠেছে এবং সেখানেই নিহিত রয়েছে বামপন্থীদের নিষ্ক্রিয়তা ও নির্জীবতার
রহস্য।
এখন কিছু কিছু বামপন্থীকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে আমাদের ভুল
হয়েছে, আমরা জাতি-বর্ণ-পরিচিতির সংগ্রামকে গুরুত্ত্ব দেইনি। এই কথাগুলি এমন এক সময়
উচ্চারিত হচ্ছে যখন আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের উপর নির্ভর একটি দল সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে
জাতি-বর্ণ-পরিচিতির সীমাকে অতিক্রম করে মানুষের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। যখন
জাতি-বর্ণ তথা পরিচিতির সংগ্রাম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনীতিকে প্রভাবিত
করছিলো, তখন শ্রেণি সম্পর্কে এক অর্থনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিচিতির সংগ্রামকে
অবজ্ঞা করা হচ্ছিল, বা কোনো সুদূরপ্রসারী তাত্ত্বিক ভিত্তি ছাড়াই ব্যবহার করার সুবিধাবাদী মানসিকতায় জড়িয়ে পড়েছিল।
কুড়ি শতিকার আশির দশক জাতি-বর্ণ-পরিচতির আন্দোলন ভারতীয়
রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিলো, তার আগে পর্যন্ত সেই আন্দোলন সামাজিক
পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ পরিচিতির অভ্যন্তরিণ শ্রেণি-ভারসাম্যের সমীকরণে
রাষ্ট্র-পরিচালনার ও রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক সুযোগ সুবিধা আদায়ে পরিচিতিগত ঐক্যের চাপ
এক সুবিধেজনক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ ছিল। শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম
পরিচিতির সংগ্রামের অধীন হয়ে পড়েছিলো।
আজকে যখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে, যখন কৃষি-সম্পর্ক থেকে
উচ্ছেদ হয়ে বা কৃষি-সম্পর্কের অভ্যন্তরে শ্রমিকশ্রেণি পরিচিতির গণ্ডি পেরিয়ে
নাগরিক আধুনিকতার সংস্পর্শে আসছে, যখন দলিত আন্দোলন মূলত আফ্রিকান-আমেরিকানদের মতো মানবিক
অধিকারের আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করছে, তখন কিছু বামপন্থীদের মনে পড়েছে
জাতি-বর্ণ-পরিচিতির আন্দোলনের কথা। আজকে আশির দশকের পরিস্থিতির ঠিক বিপরীত
বাস্তবতা দেখা দিয়েছে যখন পরিচিতির সংগ্রাম শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের অধীন হয়ে
পড়েছে।
আসলে শ্রেণি সংগ্রাম করতে হবে, জাতি-বর্ণ
সংগ্রামও করতে হবে – এই অবস্থানটাই গোলমেলে। ভারতে জাতি-বর্ণ হচ্ছে সামন্তীয়
শ্রেণি এবং বর্ণ-পরিচিতি যুগপৎভাবে কাঠামো ও উপরিকাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই
সামন্ত শ্রেণি বিভাজনের ক্যানভাসে বড়ধরনের বিভাজনের স্বরূপ এরকম - মানসিক ও কায়িক
শ্রমের বিভাজন হচ্ছে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের বিভাজন, আর উৎপাদনের হাতিয়ারের
মালিকানা ও মালিকানাহীনদের বিভাজন হচ্ছে অবিসি ও দলিত বিভাজন। কিন্তু এটা ধরে
নেওয়া ভুল যে, পুঁজিবাদ এই বিভাজনকে রূপান্তরিত করে পুঁজি ও বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্য
প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ভারতবর্ষে এই আধিপত্য ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিদেশি পুঁজির অধীনে। বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ায়ও বিদেশি পুঁজির
মাধ্যমেই নগরায়ন হয়েছিলো এবং একটি কৃষিপ্রধান দেশে লেনিন সঠিকভাবেই শ্রমিক-ক্যাডেটদের
শ্রমিক-কৃষকদের ঐক্যের অধীনে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের আহ্বান দিয়েছেলিন ১৯১৭ সালে, তবে রাশিয়ায় সংসদীয় গণতন্ত্র বর্তমান ভারতের মতো বিকশিত রূপ ছিল না।
মনে রাখতে হবে যে, মার্কস পুঁজির এই
আধিপত্যকে বলেছিলেন শ্রমিকের অধীনতা (Subsumption), পুরোনো মূল্যবোধের অবলুপ্তি
(effacement) নয়। অর্থাৎ পুরোনো শ্রমিকের বাজারের প্রতিযোগিতামূলক
শ্রমিকে রূপান্তর, শ্রমশক্তির ব্যবহার মূল্যের বিনিময় মূল্যে রূপান্তর। এই
অধীনতারও বিভিন্ন স্তর রয়েছে – আনুষ্ঠানিক, প্রকৃত বা এর মাঝামাঝি। ভারতে যে কোটি
কোটি (সরকারি হিসাবে ৪০ কোটিরও অধিক) যুবক-শ্রমিক কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে
উচ্ছেদ হয়েছে তারা এধরনের বহুবিধ অধীনতার মধ্যে রয়েছে। সার্ভিস সেক্টরে যে অসংখ্য
শ্রমিক বিভিন শহরে কাজে যুক্ত হয়েছেন তাদেরকে অনেকে পুঁজিবাদী শ্রমিক বলতে রাজী
নন, কারণ সেই শ্রমিকরা সেবা দেয়, আর উপভোক্তারা তার বিনিময়ে পেমেন্ট করেন। কিন্তু
সেই শ্রমিকদের শ্রমশক্তি যখন পুঁজিপতি কিনে নেয় এবং সেই শ্রমিকের সেবা উপভোক্তাদের
যোগান ধরে তখন সেই শ্রমিকরা পুঁজিবাদী সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করে। গাড়ি নিয়ে
গাড়ি-মালিক যখন কোম্পানীর সার্ভিস-সেন্টারে যান তখন শ্রমিকদের সেরকম সার্ভিসই
উপভোক্তা নেয় এবং পেমেন্ট করতে হয় পুঁজি-মালিককে।
যখন শ্রমিকশ্রেণি পরিচিতির অধীন ছিলো,
তখনও পরিচিতির প্রশ্ন ছিল গণতন্ত্রের প্রশ্ন, আর বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং একে অতিক্রম করে প্রকৃত
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তরের সামাজিক শক্তিটি ছিল
শ্রমিকশ্রেণি। কিন্তু যেহেতু শ্রমিকশ্রেণি জাতি-বর্ণ-পরিচিতির অধীন ছিল, তাই এই
পরিচিতির সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করে ও মধ্যবিত্তের শ্রেণি ও মতাদর্শগত নেতৃত্বকে
অতিক্রম না করে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত করা সম্ভব ছিল না। মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব জাতি-বর্ণ-পরিচিতির
যে সীমাবদ্ধ গণ্ডি নির্মাণ করে সেটা দিয়ে ব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রাম বিশেষ করে
সাম্রাজ্যবাদের যুগে সম্ভব নয়, আবার এই সংগ্রাম না করে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে
বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। পরিচিতির সংগ্রামকে অবজ্ঞা
করায় এবং এই আন্দোলনকে শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টিতে না দেখায় বামপন্থীরা তখনকার গণ-আন্দোলন ও জনসমাজ থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
আবার আজকে যখন পরিচিতির সংগ্রাম
শ্রমিকশ্রেণির অধীন হয়ে পড়েছে, তখন শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও
শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্ব ছাড়া পরিচিতির ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম সম্ভব নয়। পরিচিতির
মধ্যবিত্ত অংশের তাদের নিজ নিজ জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করারও ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়েছে।
ব্যাপক প্রলেতারীয়করণ ও নিঃস্বকরণের মধ্য
দিয়ে সমাজ-বাস্তবতায় যে শ্রমিকশ্রেণির আবির্ভাব হয়েছে তার ফলেই পরিচিতির সংগ্রাম
আর মুখ্য চলমান সংগ্রাম হয়ে বাস্তবে বিরাজ করছে না, পরিচিতির সংগ্রাম রূপ নিয়েছে
মানবিক অধিকারের সংগ্রামে - বিস্থাপনের মাধ্যমে সঞ্চয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে - পরিযায়ী
ও অস্থায়ী শ্রমিকের সংগ্রামে – অসম বিকাশ, অনুন্নয়ন ও ধ্বংসাত্মক বিকাশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে।
মেহনতি মানুষের সংগ্রামকে চলমান সামাজিক
প্রক্রিয়ার গতির মধ্যে বিচার না করে সময়ে সময়ে একেকটি খণ্ডচিত্র আবিষ্কার করে “এটাও
করতে হবে - ওটাও করতে হবে” বলার অর্থ বামপন্থী আন্দোলনকে নির্জীবতার দিকে ঠেলে
দেওয়া।
0 comments:
Post a Comment