Posted by স্বাভিমান Labels: , , , , , , ,

অসমের প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতি, সৃষ্টি ও ধ্বংস

আমাদের আইনের শাসনে উপনিবেশিক প্রভাব এখনও বিদ্যমান। শোষণ ও অবদমনের বৈধতা  প্রদানই ছিল উপনিবেশিক শাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য। দীর্ঘ সংসদীয় গণতন্ত্রে ও বিচারব্যবস্থার যাচাই প্রক্রিয়ায় নাগরিক ও জনগনের অধিকারের শাসনে্র লক্ষ্যে আইনের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন হয়।  তবে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, বিশ্বশক্তির ভারসাম্য, অভ্যন্তরিণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক  টানাপোড়েন ইত্যাদির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিপরীত যাত্রা চলছে বেশ কয়েক দশক ধরে। উপনিবেশিক কালা আইনের অপব্যবহার, নাগরিক অধিকার খর্ব করার জন্য নতুন কালা আইন জারি এবং আইনের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে নাকচ করে শাসনযন্ত্রকে অত্যাচারী ও অমানবিক করে তোলার প্রচেষ্টা আমরা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দু’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ পরিসর আগে কখনও এভাবে আক্রান্ত হয়নি, বর্তমানে যা শাসনের চরিত্রের আমূল পরিবর্তনকে সূচিত করে।  

সেই পরিসরের প্রথমটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের সাথে জনগণ বা ভোটারের সম্পর্ক যা নাগরিকত্ব আইন দিয়ে সংজ্ঞায়িত। নাগরিক হিসাবে ভোটাররা যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন তারাই সরকার কিংবা আইনসভা পরিচালনা করেন, অর্থাৎ নাগরিক হিসাবে ভোটাররাই সার্বভৌম – দেশের সার্বভৌমত্বের ধারণা তাতেই নিহিত। বেশ কয়েকবার শাসনের সেই ধারণা বাধাপ্রাপ্ত হয় – ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে, ১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধের আবহে এবং ১৯৭৫ সালের অভ্যন্তরিণ বিশৃঙ্খলার অজুহাতে কুখ্যাত ইমার্জেন্সির সময়ে। এসব করা হয় পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে জরুরীকালীন অধ্যাদেশ জারি করে। তাতে আইনের পরিবর্তন করা হয়নি, যদিও এধরনের অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতাই গণতন্ত্রের জন্য বিপদজনক।

নিওলিবারেল অর্থনীতির প্রবেশের প্রথম পর্যায়কে উন্নয়ন ও সামাজিক শান্তির নতুন যুগের সূচনা ভাবলেও, দ্বিতীয় পর্যায় থেকে শাসকশ্রেণি আম-জনতার ক্ষোভ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আঁচ করতে আরম্ভ করে। নাগরিকের সামগ্রীক জীবন রাষ্ট্রের নজরদারি ও হুকুমে পরিচালনার লক্ষ্যে আইনের পরিবর্তন হতে শুরু করে। নাগরিকত্ব আইনের পরিবর্তনে রাষ্ট্র ও নাগরিকের গনতান্ত্রিক সম্পর্কের বিপরীত যাত্রার সেই যুগ তখনই শুরু হয়ে যায়।  

অসমের নির্দ্দিষ্ট বাস্তবতায় “বিদেশি ও বহিরাগত” ইস্যু সবসময়ই এক আবেগিক বিষয়। শাসক যে তার স্থায়ী সমাধান কখনোই চাইতে পারে না, অসমের আলোকপ্রাপ্ত সমাজের এই বোধ হারিয়ে ফেলার জন্যই নাগরিক-অধিকারের বিষয়টি অসমে এক ভয়ানক রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্র অন্যায় আচরণ করবে, তাতে আশচর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বিপদ দেখা দেয় তখনই যখন রাষ্ট্রের অন্যায় সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। ইউরোপীয় ‘সিভিল সোসাইটি’ অর্থে সুশীল সমাজের অস্তিত্ব ভারতেই দুর্বল, অসমের মত প্রান্তিক অঞ্চলে তা যে অত্যন্ত দুর্বল হবে তা বলাই বাহুল্য। সেই সুশীল সমাজ ভাবতেই পারেন যে আইএমডিটি আইন বাতিল হলে বিদেশি সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু বাম-গণতান্ত্রিক শিবিরের একাংশও তা’ই ভেবেছিলেন এবং সেটা বাতিলের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। যে প্রদেশে “বিদেশি ও বহিরাগত” সমস্যা এক বাস্তব সমস্যা যার আবেগিক  ব্যবহারে জন্য শাসক ও শাসনযন্ত্র তাকে জিইয়ে রাখার ও শোষণ-প্রক্রিয়ায় অতি-শোষণের লক্ষ্যে বলপ্রয়োগে শ্রমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে, সেখানে রাষ্ট্রের হাতে এক অমোঘ অস্ত্র তুলে দেওয়ার সামাজিক স্বীকৃতি পেল। নাগরিকত্বের সন্দেহ দেখা দিলে অভিযুক্তের উপরই বর্তাবে অভিযোগ খণ্ডনের দায়। দ্বিতীয়বার এনআরসি’র প্রশ্নে শাসকের সেই ট্র্যাপে পা দিলেন “সুশীল সমাজ” ও বাম-গণতান্ত্রিক অংশ । তাঁরা ভাবলেন এনআরসি হলে অসমে “বিদেশি ও বহিরাগত” সমস্যার ক্লোজার হবে, বাস্তবে এনরাসি ও কা দু’টো আইনই নাগরিকের ঘাড়ের উপর খড়গ হিসাবে ঝুলে রইল। শাসকশ্রেণি উপর এই আস্থা ও ভ্রান্তির সূত্রপাত আসলে নিওলিবারেল অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ থেকে জাত, মুখে তারা যা’ই বলুন না কেন, মানসিক পরাজয় তাতে অন্তর্নিহিত। এবার সবচাইতে বিপদজনক ন্যারেটিভ অসমের রাজনীতিতে তৈরি হতে চলেছে।

অসমে “পুশব্যাক” এই জমানার বিষয় নয়। কিন্তু আইনের বাধা এড়িয়ে গোপনে সেটা করা হত। এবার ১৯৫০ সালের অভিবাসী বহিষ্কারের এক আইনকে ব্যবহার করে পুশব্যাকের উপর আইনি জামা পড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, প্রয়োজনে আসাম রুলসের সংশোধনও করে নেওয়া হতে পারে। ১৯ লাখ এনআরসি ছুট, অসংখ্য ডি-ভোটার, ট্রাইব্যুনালের ভুলে লক্ষাধিক “ঘোষিত বিদেশি” ভারতীয় নাগরিকদের উপস্থিতিতে কী ধরনের সামাজিক ভয়ের পরিবেশ তৈরি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সেটা নির্বাচনী তুরুপের তাস হিসাবে অতীব কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহৃত হতে পারে।

দ্বিতীয় যে পরিসরটির রাষ্ট্র সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে সেটা হলো সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন। আইনের চোখে সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে সবাই সমান। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ আইন, কৃষি বিল, শ্রম কোড ইত্যাদির মাধ্যমে আম-জনতার সম্পত্তির ও আয়ের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র যখন ইচ্ছা তখনই আম-জনতার সম্পত্তির উপর বুলডোজার চালাতে পারে, সম্পত্তি কাকে দেওয়ার জন্য? ব্যক্তিমালিক কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে এ হলো রাষ্ট্রের সেবা। এই প্রশ্নে কোন গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ হলে, রাষ্ট্র কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার বহুবিধ নজির ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। এই প্রতিরোধের আবহেও নিওলিবারেল আত্মসমর্পণ একেবারে স্পষ্ট। এবং ফলে শাসক এই প্রশ্নেও একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।    

অসমের রাজনীতিতে এই দু’টি বিষয়ের সাথে শ্রমিকের অধিকারের প্রশ্ন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, কারণ শাসকের এধরনের অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক ভূমিকার পেছনে আসল চালিকাশক্তি হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজির জন্য সস্তা শ্রম ও সস্তা সম্পদের যোগান ধরার বাধ্যবাধকতা।

আর শাসকের সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের পেছনে আসল রহস্য হচ্ছে বিরোধী শিবিরের ভূমিকা ও “সুশীল সমাজের” বিভ্রান্তি। বিরোধীরা পুঁজির মালিককে অসন্তুষ্ট করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিসরে নির্বাচনী রাজনীতি করতে অক্ষম। ফলে রাষ্ট্রের আচরণের ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র” মত। এমনকি বাম-বিরোধী শিবিরের একাংশেরও এই প্রবণতা ক্রমশঃ প্রকট হচ্ছে। সম্প্রতি সিপিএম দল কেরালা সরকারের ভূমিকার উপর সিলমোহর লাগাতে নতুন এক নীতিগত অবস্থান নিয়ে ব্যক্তি-পুঁজির গুরুত্ত্বকে সমাজবাদী গঠন প্রক্রিয়ার বাস্তবতার অঙ্গ হিসাবে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তের কী অর্থ? রাষ্ট্রীয় মালিকানার অর্থ যে সমাজবাদ নয়, সেটা সবাই স্বীকার করে, কিন্তু সেটি অবশ্যই একটি  প্রয়োজনীয় শর্ত – আবার ব্যক্তি-মালিকানা হলেই যে তা সমাজবাদী শ্রেণিসংগ্রামের দ্বারা প্রভাবিত হবে না সেরকম কোন স্বতঃসিদ্ধ নিয়মও কেউ ঘোষণা করেনি। কিন্তু নেহেরু-ইন্দিরা জমানায়, সিপিএম রাশিয়া থেকে আবিষ্কার করল যে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সমাজবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এবার বাজপেয়ী – মোদী জমানায় চিন থেকে আবিষ্কার করল ব্যক্তি-মালিকানা সমাজবাদী গঠন-প্রক্রিয়ার অঙ্গ। প্রথমটি ছিল রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের কাছে আত্ম-সমর্পণ, দ্বীতিয়টি নিওলিবারেলিজমের কাছে।  

অ-বাম বিরোধী শিবিরের দুর্বলতা আরও এককাঠি উপরে। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে “রাষ্ট্র-সর্বেসর্বা” করার যে আইনি আয়োজন চলছে, তাতে প্রাথমিকভাবে টার্গেট মুসলমানরা। কারণ, তারা মূলত কৃষিজীবী, তারা মূলত দক্ষ কায়িক-শ্রমিক, তারা সংখাগুরু ধর্মের কাছে মূল অপর ধর্ম। ফলে বিরোধীরা রাষ্ট্রের ভূমিকার বিরোধিতা করতে গিয়ে সেই আশঙ্কায় ভোগেন যে, সংখ্যাগুরুর ভোট না হাতছাড়া হয়, যদিও সেই আশঙ্কাকে গুরুত্ত্ব দিয়ে তাদের বিশেষ প্রাপ্তি ঘটেনি। কিন্তু শাসকরা তাতে মেজোরিটির সামাজিক স্বীকৃতি লাভে সফল হয়েছে, প্রথম পর্যায়ের বিজয় হাসিল করে নিয়েছে। সেই স্বীকৃতির জোরেই এবার এই নীতি প্রসারিত হচ্ছে অমুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের উপর। কিন্তু তার সার্বিক বিরোধিতার নৈতিক অবস্থান খুইয়েছে বিরোধী শিবির।

অতি-ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অতিমানব রাজনেতা তৈরি হয়। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সাথে ব্যক্তিক্ষমতারও কেন্দ্রীভবন ঘটে। অসমে কংগ্রেস শিবির সেখানে চ্যালেঞ্জ জানাতে গৌরব গগৈকে হাজির করেছেন। সেখানে ব্যক্তি-ইমেজ ভাঙাগড়ার রাজনৈতিক নাটক অব্যাহত আছে। কিন্তু শাসক শিবির তার দলের নির্বাচনী নেতৃত্বের ইমেজ-বিল্ডিংকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যেখান থেকে সাধারণ জনগণ ভাবতে শুরু করে যে ব্যক্তি নিজেই আইন।

অথচ সাধারণ জনতাই নির্বাচনে ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক। পুঁজির শোষণ, তথাকথিত উন্নয়নের যাঁতাকল, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত সাধারণ ক্ষোভিত মানুষ সমাধান চাইছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। কিন্তু সর্বশক্তিমানের কাছে, ভাষা-ধর্মের মধ্যবিত্ত অপর সৃষ্টির রাজনীতির কাছে মানুষ তখনই আত্মসমর্পণ করে, যখন বিকল্প কোন সচেতন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পরিসর অনুপস্থিত থাকে। যে রাজনীতি অমানবিক পুশব্যাককে আইনি বৈধতা দেয়, এবং অমানবিকতাই রাজনৈতিক ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা হিসাবে মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়, তাকে প্রতিহত করতে পারে রাজ্যব্যাপী বিকল্প ভাবনার সামাজিক জাগরণ ও রাজনৈতিক আর্টিকুলেশন।  

বিরোধী শিবিরের সেদিকে বিশেষ নজর নেই, তারা চাইছেন মানুষের ক্ষোভ, মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার নেতা এবং দুর্নীতির ইস্যুতে নির্বাচন লড়ে নিতে। কারণ তারা জানেন, যে দল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে সেই দলকেই কর্পোরেট পুঁজি মদত দেবে যদি বিনিময়ে তাদের স্বার্থ দেখা হয়, এই ব্যাপারে বিরোধী শিবির বিজেপি’র নীতি থেকে খুব বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন না। অসমের এক বড় সংখ্যক ভোটার চা-শ্রমিক, সেই শ্রমিকদের অধিকারের বিষয় উত্থাপনে নরম-হিন্দুত্বের রাজনীতিও ত্যাগ করতে হয় না, তথাপি চা-শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্নে নীরবতা রহস্যজনক। ফলে হার-জিতের খেলা চলছে ধ্বংসের আঙিনায়।                 

সমগ্র বিশ্বে এক ধ্বংসের আবহ বিরাজ করছে। ভারত তথা অসম কোন ব্যতিক্রম নয়। তথাপি অসম সেই মানদণ্ডেও এক বিশেষ উল্লেখ দাবি করে। মিথোলজির আধুনিক ধ্বংসের পুনর্ণির্মাণ।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় একই সময় প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠার ঊষালগ্ন। ইতিহাসবিদরা এই প্রাচীন সময়কে কো-অ্যাক্সিয়্যাল পিড়িয়ড বা একই-অক্ষের সময়কাল হিসাবে চিহ্নিত করেন। প্রাচীন সভ্যতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্ব ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে হতবাক হওয়া অনুসন্ধিৎসা। এর থেকেই জন্ম নেয় মিথোলজি’র দেবতাদের। ভারত গ্রিক সহ প্রায় সভ্যতাতেই মিথোলজির কাহিনীর সাযুজ্য রয়েছে। দ্বেষ, হিংসা, ক্রুরতা, ক্ষমতা লড়াইয়ের ভরপুর অসংখ্য দেবতা ও মিথোলজির চরিত্রে। আর এই চরিত্রগুলিই সৃষ্টির প্রতীক।

প্রেম, যুদ্ধ সব মিলিয়ে বারজন গ্রিক অলিম্পিয়ান দেবতার প্রধান জিউস। সৃষ্টির শুরুর সময়ের দেবতা হিসাবে আকাশ অথবা স্বর্গের স্বৈরশাসক ইউরেনাস ও পৃথিবী গায়া’র এক সন্তানের নাম ক্রোনাস। মাতা গায়া’র নির্দেশে ইউরেনাসের মিলনের সময় তাঁর পিতাকে হত্যা করে ক্রোনাস আকাশের দখল নেয়। ক্রোনাস তার বোন রায়াকে বিবাহ করে। কিন্তু মৃত্যুকালে তাঁর পিতা ভবিষদ্বাণী করেনে যে ক্রোনাসের মৃত্যু হবে তাঁর সন্তানের হাতে, সেই ভয়ে রায়া’র কোলে জন্মের সাথে সাথেই একে একে পাঁচ সন্তানকে সে খেয়ে ফেলে। ষষ্ঠ সন্তানকে রায়া গোপনে রক্ষা করে। সেই ষষ্ঠ সন্তান যখন তার পিতার সামনে হাজির হয়, তখন পিতার পেট থেকে বেরিয়ে আসে আগের পাঁচ সন্তান। তাদের এই নবজন্মের জন্য ষষ্ঠ সন্তান জিউস জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে টাইটানদের পরাজিত করে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালের সম্রাট হয়ে বাকী পাঁচ ভাইকে বিভিন্ন ক্ষমতার অধিপতি হিসাবে নিয়োগ করে। এতে তার মাতামহ ও পিতামহ সহযোগিতা করেন। এভাবেই অন্যান্য ক্ষমতার দেবতা হিসাবে আরও ছয় জনকে নিয়োগ করে।

এথেনার জন্মও চিত্তাকর্ষক। জ্ঞানী ও গুণী অলিম্পিয়া-পূর্ব টাইটান দেবী ম্যাটিস জিউসের পরামর্শদাতা, আবার তাদের মধ্যেও ভালবাসার আকর্ষণ রয়েছে। দেবতাদের এক বিবাহ অনুষ্ঠানে জিউস বিভিন্ন রূপে ম্যাটিসের পেছনে ধাওয়া করে, ম্যাটিস পাহাড়ের ছোট গর্তে ঢুকে গেলে সাপ হয়ে ভেতরে গিয়ে ম্যাটিসকে জড়িয়ে ফেলে। জিউস আদর করে দাবি করে যে জিউস ম্যাটিস থেকে বেশি বুদ্ধিমান সেটা প্রমাণিত হলো। প্রত্যুত্তরে ম্যাটিস বলে যে সে যদি ধরা দিতে চাইত না, তাহলে জিউস তাকে ধরতে পারত না। সেটা পরীক্ষা করতে ম্যাটিস ফড়িং সেজে গলিয়ে বেরিয়ে গেলে জিউস গিরগিটি রূপে ম্যাটিসকে গিলে ফেলে। এরপর ম্যাটিসের প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়। ব্যাথার উপসম না হলে ভেতেরে কী আছে তা দেখতে জিউসের মাথা দু’ভাগে কাটলে বেরিয়ে আসে জিউসের কন্যা অতীব রূপসী ও গুনবতী দেবী এথেনা। এভাবে বিশ্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের পরিচয় ঘটার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মিথোলজির দেবতা ও চরিত্র বাড়তে থাকে।

এবার ধ্বংসের পালা। সর্বময় ক্ষমতার অধিকর্তা হিসাবে হাজির রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী রাজনেতা। পরামর্শদাতা দানব পুঁজির প্রেমে পেছনে ছুটতে ছুটতে জল, জমিন, জঙ্গল সব ধ্বংস করে নিচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে মানুষের জীবন জীবিকা। বদলা নিতে উত্তপ্ত হচ্ছে ধরিত্রী। ধ্বংস, যুদ্ধ, তাণ্ডবের দেবতারা জেগে উঠছেন। পৌরানিক মিথোলজির মত সৃষ্টির ক্ষমতা আর দেবতাদের হাতে নেই।  সৃষ্টি, সৌহার্দ্য, শান্তির দূতরা লুকিয়ে আছে মেহনতি জনতার মধ্যে। ধ্বংসের দেবতাদের মধ্যে লড়াইয়ের আবহেই জাগিয়ে তুলতে হবে মেহনতি জনতার সামাজিক শক্তিকে। প্রাচীন মিথোলজিতে ছিল দ্বান্দ্বিকতা – সৃষ্টির জন্য ধ্বংস, প্রেমের জন্য ঘৃণা, ভালবাসার জন্য যুদ্ধ। এবার শুধু ধ্বংসের একমাত্রিকতা, সৃষ্টি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইছে, সেই বিচ্ছিন্নতাই মেহনতির নতুন লড়াই সৃষ্টির নতুন দ্বান্দ্বিকতায়।                    

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

 জল ডিপ্লোমেসি, জল যুদ্ধ ও বানের জল

পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে একটা যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছিল, যদিও সন্ত্রাসীদের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা সন্ত্রাসী প্রাইভেট বাহিনীকে যে রাষ্ট্রীয় মদতে ব্যবহার করে সে অভিযোগ সত্য। শাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর আধিপত্য ও আফগানিস্তানে রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যবহার করার পুরোনো আমেরিকান নীতি – এই দু’য়ের সংশ্লষে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা শাসন ব্যবস্থায় গেড়ে বসে। এই দুষ্টচক্রের ভুক্তভোগী প্রতিবেশী ভারত তো বটেই, পাকিস্তান নিজেও।

এর থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ খোলা ছিল – পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এব্যাপারে নেহরুর আমল থেকে মোদীর আমল কখনও এক শক্তিশালী বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারত কোন সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে? এই উপ-মহাদেশে সব অস্থিরতার জড় নিহিত দেশ-বিভাজনে,  তার পরবর্তী ভূগোলকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বিভাজনের পর? ভারত – পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে উভয়পক্ষই ক্ষমতায় টিঁকে থাকার উপায় হিসাবে ব্যবহার করতে কম কসরৎ করেনি। অথচ পাকিস্তানে গনতন্ত্র বিকশিত হলে ও সামরিক বাহিনীর বিপরীতে রাজনৈতিক-শ্রেণির হাতে ক্ষমতা থাকলে ভারতেরই লাভ। তার জন্য প্রধান শর্ত হলো পাকিস্তানি জনগণের আস্থা অর্জন করা।

দেশ-বিভাজনের পরপরই দু’দেশের মধ্যে জলবন্টন নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রায় আশি শতাংশ অঞ্চল, গুরুত্ত্বপূর্ণ শহর ও ব্যাপক গ্রামাঞ্চল সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের জলের উপর নির্ভরশীল। সেই সময়ে উভয় দেশই সম্পূর্ণ কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি, পাকিস্তানের নগরায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্ধনের পুরোটাই প্রায় জল-বিদ্যুৎ। খাদ্য সুরক্ষা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ অর্থাৎ সামগ্রীকভাবে সমগ্র অর্থনীতি নির্ভরশীল সিন্ধু অববাহিকার জলপ্রবাহের উপর। মোট ছয়টি নদি ভারতের কাশ্মীর উপত্যকা হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। ফলে পাকিস্তানের আশঙ্কা ছিল যে নদির উজানে যদি ভারত জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে পাকিস্তানের ৮০% মানুষের জীবন জীবিকা, বন্যা খরা, ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ভারত উজানে অধিকার দাবি করে  ও পাকিস্তান সেই জল-প্রবাহের উপর অধিকার দাবি করে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর  বিশ্ব-ব্যাঙ্কের মধ্যস্ততায় ১৯৬০ সালে সামরিক শাসক আয়ুব খান ও নেহেরুর শাসনামলে জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই মধ্যস্ততা ছিল ভারতের নৈতিক পরাজয়, বৃহৎ অর্থনীতির পড়শি দেশ হিসাবে দ্বিপাক্ষিক সমাধান করার ক্রেডিট ভারত নিতে পারত। সেই চুক্তি মতে সিন্দু বেসিনের পূবের নদি বিয়াস, রবি ও সুতলেজ এই তিনটির উপর ভারতের প্রাধাণ্য এবং পশ্চিমের চেনাব, ঝিলম ও সিন্ধু এই তিনটির জলের উপর পাকিস্তানের প্রাধাণ্য স্বীকৃত হয়। ভারত ও পাক সংঘাতে এই জলচুক্তি মতে জলবন্টন না করার ঘোষণাকে অস্ত্র হিসাবে ভারত ২০০১, ২০১৬ সালে ব্যবহার করে, এবার ২০২৫ সালে আবারব্যবহৃত হলো। এ নিয়ে পাকিস্তান হুঙ্কার দিলেও, এই মুহূর্তেই যে বিষয়টি নিয়ে কোন উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না, তার কারণ উজানে জল ধরে রাখার মত এমন কোন পরিকাঠামো নেই যা পাকিস্তানে জল-প্রবাহকে ভীষণভাবে প্রবাভিত করতে পারে। যে জলবিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ হচ্ছে তাও শেষ হতে অন্তত ২০৩২ সাল পর্যন্ত যাবে। কিন্তু জলপ্রবাহের তথ্য না দিয়ে পাকিস্তানের জল-ব্যবস্থাপনায় বাধা তৈরি করতে পারে, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই বন্যা সৃষ্টি করে পাকিস্তানের জনগণের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত করার অভিযোগ উত্থাপন করেছে।  জনগণের বিপর্যস্ত অবস্থাকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে ভারত বিরোধী জিগিরকে ব্যবহার করে। এবারও গণতন্ত্রের বিকাশের বদলে এই সুযোগে পাকিস্তানের আর্মি চিফ পদোন্নতি পেলেন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের অবস্থানকে পোক্ত করলেন। 

নেপালের বাণিজ্যের সড়ক পথ, বাংলাদেশের বাণিজ্যের সমুদ্র পথ, পাকিস্তানের জল বন্টন এসব নিয়ে কূটনৈতিক চাপ তৈরির প্রচেষ্টায় যেহেতু সরাসরি জনগণের জীবনযাপনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ফলে এই ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত ফল দেয়। বাংলাদেশ ও   নেপালের সাথে যখন সম্পর্কেটানাপোড়েন চলছে তখন জলচুক্তি স্থগিত তাদেরও শঙ্কিত করবে। এই সবগুলি প্রতিবেশি দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে চিন। ভারত পাকিস্তানের সাথে আপার-স্ট্রিমের যখন সুযোগ নিচ্ছে, তখন সেদিকে সিন্ধু ও সুতলেজের এবং এদিকে ব্রহ্মপুত্রের ভারতের সাথে চিনের আপারস্ট্রিম রয়েছে। চিনের সাথে ভারতের কোন ধরনের চুক্তিও নেই। সুতরাং চিনও ভারতের সাথে একই ধরনের ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে, এনিয়ে দর-কষাকষি করে ভিন্নতর আর্থিক সুবিধাও আদায় করে নিতে পারে। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।  

এবার যখন ভারতের সাথে যুদ্ধোন্মাদনা দেখা দেয়, তখন বাম-গণতান্ত্রিক শিবির থেকে “যুদ্ধ নয় শান্তি” চাই এই দাবি ওঠে। সব দেশের শাসক পরিস্থিতি অনুযায়ী যুদ্ধও চায়, আবারও শান্তিও চায়। তাদের সেই যুদ্ধ ও শান্তির খেলা জাতি’র কাল্পনিক স্বাভিমান ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার আধারে নির্মিত। আর সেই যুদ্ধ ও শান্তির নির্মাণ আসলে পুঁজিপতি শ্রেণির নিজেদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার স্বরূপ দিয়ে নির্ধারিত। যেহেতু প্রতিযোগিতা নির্ধারক, তা’ই আসলে যুদ্ধ অবিরত, ফারাক শুধু সামরিক শক্তি প্রয়োগের চরিত্রে। পুঁজির অভ্যন্তরিণ প্রতিযোগিতার জাতি – রাষ্ট্রগত সহাবস্থানের স্তর হচ্ছে শান্তি এবং তারই ধারাবাহিকতা হচ্ছে যুদ্ধ। দেশ বিভাজন ছিল তারই পরিণতি এবং সেজন্যই ঘনশ্যাম দাস বিড়লা প্রথম দেশ-বিভাজনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ফলে “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” এই বাক্য-বিন্যাসের কোন অর্থ দাঁড়ায় না, যদি তাতে শ্রমজীবীদের ঐক্যের আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন সদর্থক অন্তর্বস্তু না থাকে? ফলে জলবন্টনের মত বিষয় যা  জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকাকে নির্ধারিত করে ও বিপর্যস্ত করে, উভয় দেশের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেই বিষয়কে যদি উত্থাপন করা না যায়,  তাহলে “যুদ্ধ নয় শান্তির” বাম-রাজনীতির কী অর্থ দাঁড়ায়?

ভারতের পড়শি দেশের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হচ্ছে চিন। পুঁজিবাদী শক্তি হিসাবে চিনের উত্থান ও বিশ্ব ব্যবস্থায় তার প্রভাব নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সহ একটি নিবন্ধ অতি সত্বর এক বিশেষ আকাদেমিক জার্নালে প্রকাশ পাবে। এ বিষয়কে এখানে আলোচনায় আনছি না। কিন্তু দেশ – জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গীতেও যদি দেখা যায়, তাহলে ভারতকে চিনের সাথে প্রতিযোগিতা করেই তাকে বিকশিত করতে হবে। আর এর জন্য ভারতকে তার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপর গুরুত্ত্ব দিতে হবে। কিন্তু বিজেপি সরকার কাল্পনিক বিশ্বগুরু সাজার বাসনা থেকে পরনির্ভর বিদেশ নীতির অবলম্বন ও আঞ্চলিক দাদাগিরি ফলাতে গিয়ে প্রতিবেশী সবগুলি দেশে চিনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে।

বিশ্ব-ব্যবস্থায় যখন এক অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলে, তখনই উৎকৃষ্ট সময় স্বনির্ভর অর্থনীতি ও জোট-নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অবলম্বন করার। ব্রিটিশ সূর্য ডোবার ও আমেরিকার বিশ্বশক্তি হিসাবে উত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ের সময় ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। কিন্তু নেহেরু সেই সুযোগের যে সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারেননি বা করেননি তার জন্য বহুলাংশে দায়ি বামপন্থীদের ভুল নীতি ও ব্যর্থতা। শীতল-যুদ্ধের পর্যায়ে জোট-নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করলেও, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বনির্ভর অর্থনীতির বিকাশে যে প্রয়োজনীয় আমূল পরিবর্তনের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল তা নেওয়া হয়নি। তার পরিণতিতে পরবর্তীতে নিওলিবারেলিজমের সাথে সমঝোতা করতে হয়। সেই সমঝোতাকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং একইসাথে বাস্তবকে আড়াল করার জন্য ব্লকবাস্টার কমার্শিয়্যাল মুভির শিল্পকলাকে ব্যবহার করে বিজেপি সরকার।  

এখন বিশ্ব-ব্যবস্থায় আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলছে, নেহেরুর আমল থেকে বাস্তব আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তখন স্বাধীনতার সংগ্রামের রেশ হিসাবে  শাসক দলের মধ্যে  কিছুটা হলেও দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। বামপন্থীরা শ্রেণিসংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেই ভিত্তিতে একটি শিবির হিসাবে শাসনকে প্রভাবিত করার অবস্থায় ছিলেন। ডান দিক থেকে যে বিরোধী ছিল, তারা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। বর্তমানে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই তার বিপরীত। রাষ্ট্রচরিত্রের ধারনায় রাজনৈতিক ফারাক থাকলেও অর্থনীতির প্রশ্নে বিজেপি ও কংগ্রেস প্রতিযোগিতা আমেরিকার ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানদের মতো এক বাই-পার্টিজান বিভাজন।

আসামের বন্যার সাথে সেই অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে আমূল ভূমি-সংস্কারের পরিবর্তে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির জন্য অবাধ জমি দখল, পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। শুধু বাজার ও শহরের কথা ভেবে, কৃষিকে ব্রাত্য করে, বাঁধ দিয়ে নদি নিয়ন্ত্রণের পলিসি প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সুফল দিলেও, এখন শহরবাসীকেও নরক-যন্ত্রণায় ঠেলে দিয়েছে। বেকেন্দ্রীভূত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব সম্ভাবনাকে খারিজ করে বৃহৎ নদি বাঁধ প্রকল্প জনজীবনে যে কতটা অভিশাপ ডেকে আনতে পারে তা উজনি অসমের ভুক্তভোগী জনগণ প্রতিবছর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সরকার নির্বিকার।

অভ্যন্তরিণ এই পরনির্ভর নীতি এবং প্রতিবেশি দেশের প্রতি শাসকীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের বাসনা, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে আত্মসমর্পনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সিন্ধু ও সুতলেজের ক্ষেত্রে যদি চিন (যার সাথে পাকিস্তানের মত কোন চুক্তিও নেই) আপারস্ট্রিমের অন্যায় সুবিধা নিতে চায়, তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের যুক্তি কী থাকবে? তিব্বতে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে চিন শুধু হিমালয়ান রেঞ্জে পরিবেশ ভারসাম্যের ক্ষতি ডেকে আনছে না, ব্রহ্মপুত্রের জলপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিচ্ছে। অসমের খরা ও বন্যায় অসম ও ভারত সরকারকে তখন নিরুপায় দর্শক হওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকবে না। এখনই ভারত সরকার নিরুপায়, ভারতের সাথে আলোচনা না করে চিনের এই প্রকল্পে অনুমোদন নিয়ে অরুণাচল প্রদেশ সরকার আপত্তি জানালেও, ভারত সরকার নীরব।  

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন