Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

 জল ডিপ্লোমেসি, জল যুদ্ধ ও বানের জল

পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে একটা যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছিল, যদিও সন্ত্রাসীদের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা সন্ত্রাসী প্রাইভেট বাহিনীকে যে রাষ্ট্রীয় মদতে ব্যবহার করে সে অভিযোগ সত্য। শাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর আধিপত্য ও আফগানিস্তানে রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যবহার করার পুরোনো আমেরিকান নীতি – এই দু’য়ের সংশ্লষে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা শাসন ব্যবস্থায় গেড়ে বসে। এই দুষ্টচক্রের ভুক্তভোগী প্রতিবেশী ভারত তো বটেই, পাকিস্তান নিজেও।

এর থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ খোলা ছিল – পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এব্যাপারে নেহরুর আমল থেকে মোদীর আমল কখনও এক শক্তিশালী বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারত কোন সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে? এই উপ-মহাদেশে সব অস্থিরতার জড় নিহিত দেশ-বিভাজনে,  তার পরবর্তী ভূগোলকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বিভাজনের পর? ভারত – পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে উভয়পক্ষই ক্ষমতায় টিঁকে থাকার উপায় হিসাবে ব্যবহার করতে কম কসরৎ করেনি। অথচ পাকিস্তানে গনতন্ত্র বিকশিত হলে ও সামরিক বাহিনীর বিপরীতে রাজনৈতিক-শ্রেণির হাতে ক্ষমতা থাকলে ভারতেরই লাভ। তার জন্য প্রধান শর্ত হলো পাকিস্তানি জনগণের আস্থা অর্জন করা।

দেশ-বিভাজনের পরপরই দু’দেশের মধ্যে জলবন্টন নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রায় আশি শতাংশ অঞ্চল, গুরুত্ত্বপূর্ণ শহর ও ব্যাপক গ্রামাঞ্চল সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের জলের উপর নির্ভরশীল। সেই সময়ে উভয় দেশই সম্পূর্ণ কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি, পাকিস্তানের নগরায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্ধনের পুরোটাই প্রায় জল-বিদ্যুৎ। খাদ্য সুরক্ষা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ অর্থাৎ সামগ্রীকভাবে সমগ্র অর্থনীতি নির্ভরশীল সিন্ধু অববাহিকার জলপ্রবাহের উপর। মোট ছয়টি নদি ভারতের কাশ্মীর উপত্যকা হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। ফলে পাকিস্তানের আশঙ্কা ছিল যে নদির উজানে যদি ভারত জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে পাকিস্তানের ৮০% মানুষের জীবন জীবিকা, বন্যা খরা, ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ভারত উজানে অধিকার দাবি করে  ও পাকিস্তান সেই জল-প্রবাহের উপর অধিকার দাবি করে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর  বিশ্ব-ব্যাঙ্কের মধ্যস্ততায় ১৯৬০ সালে সামরিক শাসক আয়ুব খান ও নেহেরুর শাসনামলে জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই মধ্যস্ততা ছিল ভারতের নৈতিক পরাজয়, বৃহৎ অর্থনীতির পড়শি দেশ হিসাবে দ্বিপাক্ষিক সমাধান করার ক্রেডিট ভারত নিতে পারত। সেই চুক্তি মতে সিন্দু বেসিনের পূবের নদি বিয়াস, রবি ও সুতলেজ এই তিনটির উপর ভারতের প্রাধাণ্য এবং পশ্চিমের চেনাব, ঝিলম ও সিন্ধু এই তিনটির জলের উপর পাকিস্তানের প্রাধাণ্য স্বীকৃত হয়। ভারত ও পাক সংঘাতে এই জলচুক্তি মতে জলবন্টন না করার ঘোষণাকে অস্ত্র হিসাবে ভারত ২০০১, ২০১৬ সালে ব্যবহার করে, এবার ২০২৫ সালে আবারব্যবহৃত হলো। এ নিয়ে পাকিস্তান হুঙ্কার দিলেও, এই মুহূর্তেই যে বিষয়টি নিয়ে কোন উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না, তার কারণ উজানে জল ধরে রাখার মত এমন কোন পরিকাঠামো নেই যা পাকিস্তানে জল-প্রবাহকে ভীষণভাবে প্রবাভিত করতে পারে। যে জলবিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ হচ্ছে তাও শেষ হতে অন্তত ২০৩২ সাল পর্যন্ত যাবে। কিন্তু জলপ্রবাহের তথ্য না দিয়ে পাকিস্তানের জল-ব্যবস্থাপনায় বাধা তৈরি করতে পারে, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই বন্যা সৃষ্টি করে পাকিস্তানের জনগণের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত করার অভিযোগ উত্থাপন করেছে।  জনগণের বিপর্যস্ত অবস্থাকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে ভারত বিরোধী জিগিরকে ব্যবহার করে। এবারও গণতন্ত্রের বিকাশের বদলে এই সুযোগে পাকিস্তানের আর্মি চিফ পদোন্নতি পেলেন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের অবস্থানকে পোক্ত করলেন। 

নেপালের বাণিজ্যের সড়ক পথ, বাংলাদেশের বাণিজ্যের সমুদ্র পথ, পাকিস্তানের জল বন্টন এসব নিয়ে কূটনৈতিক চাপ তৈরির প্রচেষ্টায় যেহেতু সরাসরি জনগণের জীবনযাপনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ফলে এই ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত ফল দেয়। বাংলাদেশ ও   নেপালের সাথে যখন সম্পর্কেটানাপোড়েন চলছে তখন জলচুক্তি স্থগিত তাদেরও শঙ্কিত করবে। এই সবগুলি প্রতিবেশি দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে চিন। ভারত পাকিস্তানের সাথে আপার-স্ট্রিমের যখন সুযোগ নিচ্ছে, তখন সেদিকে সিন্ধু ও সুতলেজের এবং এদিকে ব্রহ্মপুত্রের ভারতের সাথে চিনের আপারস্ট্রিম রয়েছে। চিনের সাথে ভারতের কোন ধরনের চুক্তিও নেই। সুতরাং চিনও ভারতের সাথে একই ধরনের ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে, এনিয়ে দর-কষাকষি করে ভিন্নতর আর্থিক সুবিধাও আদায় করে নিতে পারে। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।  

এবার যখন ভারতের সাথে যুদ্ধোন্মাদনা দেখা দেয়, তখন বাম-গণতান্ত্রিক শিবির থেকে “যুদ্ধ নয় শান্তি” চাই এই দাবি ওঠে। সব দেশের শাসক পরিস্থিতি অনুযায়ী যুদ্ধও চায়, আবারও শান্তিও চায়। তাদের সেই যুদ্ধ ও শান্তির খেলা জাতি’র কাল্পনিক স্বাভিমান ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার আধারে নির্মিত। আর সেই যুদ্ধ ও শান্তির নির্মাণ আসলে পুঁজিপতি শ্রেণির নিজেদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার স্বরূপ দিয়ে নির্ধারিত। যেহেতু প্রতিযোগিতা নির্ধারক, তা’ই আসলে যুদ্ধ অবিরত, ফারাক শুধু সামরিক শক্তি প্রয়োগের চরিত্রে। পুঁজির অভ্যন্তরিণ প্রতিযোগিতার জাতি – রাষ্ট্রগত সহাবস্থানের স্তর হচ্ছে শান্তি এবং তারই ধারাবাহিকতা হচ্ছে যুদ্ধ। দেশ বিভাজন ছিল তারই পরিণতি এবং সেজন্যই ঘনশ্যাম দাস বিড়লা প্রথম দেশ-বিভাজনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ফলে “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” এই বাক্য-বিন্যাসের কোন অর্থ দাঁড়ায় না, যদি তাতে শ্রমজীবীদের ঐক্যের আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন সদর্থক অন্তর্বস্তু না থাকে? ফলে জলবন্টনের মত বিষয় যা  জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকাকে নির্ধারিত করে ও বিপর্যস্ত করে, উভয় দেশের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেই বিষয়কে যদি উত্থাপন করা না যায়,  তাহলে “যুদ্ধ নয় শান্তির” বাম-রাজনীতির কী অর্থ দাঁড়ায়?

ভারতের পড়শি দেশের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হচ্ছে চিন। পুঁজিবাদী শক্তি হিসাবে চিনের উত্থান ও বিশ্ব ব্যবস্থায় তার প্রভাব নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সহ একটি নিবন্ধ অতি সত্বর এক বিশেষ আকাদেমিক জার্নালে প্রকাশ পাবে। এ বিষয়কে এখানে আলোচনায় আনছি না। কিন্তু দেশ – জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গীতেও যদি দেখা যায়, তাহলে ভারতকে চিনের সাথে প্রতিযোগিতা করেই তাকে বিকশিত করতে হবে। আর এর জন্য ভারতকে তার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপর গুরুত্ত্ব দিতে হবে। কিন্তু বিজেপি সরকার কাল্পনিক বিশ্বগুরু সাজার বাসনা থেকে পরনির্ভর বিদেশ নীতির অবলম্বন ও আঞ্চলিক দাদাগিরি ফলাতে গিয়ে প্রতিবেশী সবগুলি দেশে চিনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে।

বিশ্ব-ব্যবস্থায় যখন এক অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলে, তখনই উৎকৃষ্ট সময় স্বনির্ভর অর্থনীতি ও জোট-নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অবলম্বন করার। ব্রিটিশ সূর্য ডোবার ও আমেরিকার বিশ্বশক্তি হিসাবে উত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ের সময় ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। কিন্তু নেহেরু সেই সুযোগের যে সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারেননি বা করেননি তার জন্য বহুলাংশে দায়ি বামপন্থীদের ভুল নীতি ও ব্যর্থতা। শীতল-যুদ্ধের পর্যায়ে জোট-নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করলেও, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বনির্ভর অর্থনীতির বিকাশে যে প্রয়োজনীয় আমূল পরিবর্তনের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল তা নেওয়া হয়নি। তার পরিণতিতে পরবর্তীতে নিওলিবারেলিজমের সাথে সমঝোতা করতে হয়। সেই সমঝোতাকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং একইসাথে বাস্তবকে আড়াল করার জন্য ব্লকবাস্টার কমার্শিয়্যাল মুভির শিল্পকলাকে ব্যবহার করে বিজেপি সরকার।  

এখন বিশ্ব-ব্যবস্থায় আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলছে, নেহেরুর আমল থেকে বাস্তব আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তখন স্বাধীনতার সংগ্রামের রেশ হিসাবে  শাসক দলের মধ্যে  কিছুটা হলেও দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। বামপন্থীরা শ্রেণিসংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেই ভিত্তিতে একটি শিবির হিসাবে শাসনকে প্রভাবিত করার অবস্থায় ছিলেন। ডান দিক থেকে যে বিরোধী ছিল, তারা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। বর্তমানে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই তার বিপরীত। রাষ্ট্রচরিত্রের ধারনায় রাজনৈতিক ফারাক থাকলেও অর্থনীতির প্রশ্নে বিজেপি ও কংগ্রেস প্রতিযোগিতা আমেরিকার ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানদের মতো এক বাই-পার্টিজান বিভাজন।

আসামের বন্যার সাথে সেই অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে আমূল ভূমি-সংস্কারের পরিবর্তে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির জন্য অবাধ জমি দখল, পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। শুধু বাজার ও শহরের কথা ভেবে, কৃষিকে ব্রাত্য করে, বাঁধ দিয়ে নদি নিয়ন্ত্রণের পলিসি প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সুফল দিলেও, এখন শহরবাসীকেও নরক-যন্ত্রণায় ঠেলে দিয়েছে। বেকেন্দ্রীভূত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব সম্ভাবনাকে খারিজ করে বৃহৎ নদি বাঁধ প্রকল্প জনজীবনে যে কতটা অভিশাপ ডেকে আনতে পারে তা উজনি অসমের ভুক্তভোগী জনগণ প্রতিবছর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সরকার নির্বিকার।

অভ্যন্তরিণ এই পরনির্ভর নীতি এবং প্রতিবেশি দেশের প্রতি শাসকীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের বাসনা, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে আত্মসমর্পনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সিন্ধু ও সুতলেজের ক্ষেত্রে যদি চিন (যার সাথে পাকিস্তানের মত কোন চুক্তিও নেই) আপারস্ট্রিমের অন্যায় সুবিধা নিতে চায়, তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের যুক্তি কী থাকবে? তিব্বতে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে চিন শুধু হিমালয়ান রেঞ্জে পরিবেশ ভারসাম্যের ক্ষতি ডেকে আনছে না, ব্রহ্মপুত্রের জলপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিচ্ছে। অসমের খরা ও বন্যায় অসম ও ভারত সরকারকে তখন নিরুপায় দর্শক হওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকবে না। এখনই ভারত সরকার নিরুপায়, ভারতের সাথে আলোচনা না করে চিনের এই প্রকল্পে অনুমোদন নিয়ে অরুণাচল প্রদেশ সরকার আপত্তি জানালেও, ভারত সরকার নীরব।  

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন