Posted by স্বাভিমান Labels: , , , , , , ,

অসমের প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতি, সৃষ্টি ও ধ্বংস

আমাদের আইনের শাসনে উপনিবেশিক প্রভাব এখনও বিদ্যমান। শোষণ ও অবদমনের বৈধতা  প্রদানই ছিল উপনিবেশিক শাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য। দীর্ঘ সংসদীয় গণতন্ত্রে ও বিচারব্যবস্থার যাচাই প্রক্রিয়ায় নাগরিক ও জনগনের অধিকারের শাসনে্র লক্ষ্যে আইনের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন হয়।  তবে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, বিশ্বশক্তির ভারসাম্য, অভ্যন্তরিণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক  টানাপোড়েন ইত্যাদির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিপরীত যাত্রা চলছে বেশ কয়েক দশক ধরে। উপনিবেশিক কালা আইনের অপব্যবহার, নাগরিক অধিকার খর্ব করার জন্য নতুন কালা আইন জারি এবং আইনের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে নাকচ করে শাসনযন্ত্রকে অত্যাচারী ও অমানবিক করে তোলার প্রচেষ্টা আমরা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দু’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ পরিসর আগে কখনও এভাবে আক্রান্ত হয়নি, বর্তমানে যা শাসনের চরিত্রের আমূল পরিবর্তনকে সূচিত করে।  

সেই পরিসরের প্রথমটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের সাথে জনগণ বা ভোটারের সম্পর্ক যা নাগরিকত্ব আইন দিয়ে সংজ্ঞায়িত। নাগরিক হিসাবে ভোটাররা যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন তারাই সরকার কিংবা আইনসভা পরিচালনা করেন, অর্থাৎ নাগরিক হিসাবে ভোটাররাই সার্বভৌম – দেশের সার্বভৌমত্বের ধারণা তাতেই নিহিত। বেশ কয়েকবার শাসনের সেই ধারণা বাধাপ্রাপ্ত হয় – ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে, ১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধের আবহে এবং ১৯৭৫ সালের অভ্যন্তরিণ বিশৃঙ্খলার অজুহাতে কুখ্যাত ইমার্জেন্সির সময়ে। এসব করা হয় পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে জরুরীকালীন অধ্যাদেশ জারি করে। তাতে আইনের পরিবর্তন করা হয়নি, যদিও এধরনের অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতাই গণতন্ত্রের জন্য বিপদজনক।

নিওলিবারেল অর্থনীতির প্রবেশের প্রথম পর্যায়কে উন্নয়ন ও সামাজিক শান্তির নতুন যুগের সূচনা ভাবলেও, দ্বিতীয় পর্যায় থেকে শাসকশ্রেণি আম-জনতার ক্ষোভ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আঁচ করতে আরম্ভ করে। নাগরিকের সামগ্রীক জীবন রাষ্ট্রের নজরদারি ও হুকুমে পরিচালনার লক্ষ্যে আইনের পরিবর্তন হতে শুরু করে। নাগরিকত্ব আইনের পরিবর্তনে রাষ্ট্র ও নাগরিকের গনতান্ত্রিক সম্পর্কের বিপরীত যাত্রার সেই যুগ তখনই শুরু হয়ে যায়।  

অসমের নির্দ্দিষ্ট বাস্তবতায় “বিদেশি ও বহিরাগত” ইস্যু সবসময়ই এক আবেগিক বিষয়। শাসক যে তার স্থায়ী সমাধান কখনোই চাইতে পারে না, অসমের আলোকপ্রাপ্ত সমাজের এই বোধ হারিয়ে ফেলার জন্যই নাগরিক-অধিকারের বিষয়টি অসমে এক ভয়ানক রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্র অন্যায় আচরণ করবে, তাতে আশচর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বিপদ দেখা দেয় তখনই যখন রাষ্ট্রের অন্যায় সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। ইউরোপীয় ‘সিভিল সোসাইটি’ অর্থে সুশীল সমাজের অস্তিত্ব ভারতেই দুর্বল, অসমের মত প্রান্তিক অঞ্চলে তা যে অত্যন্ত দুর্বল হবে তা বলাই বাহুল্য। সেই সুশীল সমাজ ভাবতেই পারেন যে আইএমডিটি আইন বাতিল হলে বিদেশি সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু বাম-গণতান্ত্রিক শিবিরের একাংশও তা’ই ভেবেছিলেন এবং সেটা বাতিলের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। যে প্রদেশে “বিদেশি ও বহিরাগত” সমস্যা এক বাস্তব সমস্যা যার আবেগিক  ব্যবহারে জন্য শাসক ও শাসনযন্ত্র তাকে জিইয়ে রাখার ও শোষণ-প্রক্রিয়ায় অতি-শোষণের লক্ষ্যে বলপ্রয়োগে শ্রমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে, সেখানে রাষ্ট্রের হাতে এক অমোঘ অস্ত্র তুলে দেওয়ার সামাজিক স্বীকৃতি পেল। নাগরিকত্বের সন্দেহ দেখা দিলে অভিযুক্তের উপরই বর্তাবে অভিযোগ খণ্ডনের দায়। দ্বিতীয়বার এনআরসি’র প্রশ্নে শাসকের সেই ট্র্যাপে পা দিলেন “সুশীল সমাজ” ও বাম-গণতান্ত্রিক অংশ । তাঁরা ভাবলেন এনআরসি হলে অসমে “বিদেশি ও বহিরাগত” সমস্যার ক্লোজার হবে, বাস্তবে এনরাসি ও কা দু’টো আইনই নাগরিকের ঘাড়ের উপর খড়গ হিসাবে ঝুলে রইল। শাসকশ্রেণি উপর এই আস্থা ও ভ্রান্তির সূত্রপাত আসলে নিওলিবারেল অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ থেকে জাত, মুখে তারা যা’ই বলুন না কেন, মানসিক পরাজয় তাতে অন্তর্নিহিত। এবার সবচাইতে বিপদজনক ন্যারেটিভ অসমের রাজনীতিতে তৈরি হতে চলেছে।

অসমে “পুশব্যাক” এই জমানার বিষয় নয়। কিন্তু আইনের বাধা এড়িয়ে গোপনে সেটা করা হত। এবার ১৯৫০ সালের অভিবাসী বহিষ্কারের এক আইনকে ব্যবহার করে পুশব্যাকের উপর আইনি জামা পড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, প্রয়োজনে আসাম রুলসের সংশোধনও করে নেওয়া হতে পারে। ১৯ লাখ এনআরসি ছুট, অসংখ্য ডি-ভোটার, ট্রাইব্যুনালের ভুলে লক্ষাধিক “ঘোষিত বিদেশি” ভারতীয় নাগরিকদের উপস্থিতিতে কী ধরনের সামাজিক ভয়ের পরিবেশ তৈরি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সেটা নির্বাচনী তুরুপের তাস হিসাবে অতীব কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহৃত হতে পারে।

দ্বিতীয় যে পরিসরটির রাষ্ট্র সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে সেটা হলো সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন। আইনের চোখে সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে সবাই সমান। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ আইন, কৃষি বিল, শ্রম কোড ইত্যাদির মাধ্যমে আম-জনতার সম্পত্তির ও আয়ের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র যখন ইচ্ছা তখনই আম-জনতার সম্পত্তির উপর বুলডোজার চালাতে পারে, সম্পত্তি কাকে দেওয়ার জন্য? ব্যক্তিমালিক কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে এ হলো রাষ্ট্রের সেবা। এই প্রশ্নে কোন গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ হলে, রাষ্ট্র কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার বহুবিধ নজির ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। এই প্রতিরোধের আবহেও নিওলিবারেল আত্মসমর্পণ একেবারে স্পষ্ট। এবং ফলে শাসক এই প্রশ্নেও একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।    

অসমের রাজনীতিতে এই দু’টি বিষয়ের সাথে শ্রমিকের অধিকারের প্রশ্ন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, কারণ শাসকের এধরনের অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক ভূমিকার পেছনে আসল চালিকাশক্তি হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজির জন্য সস্তা শ্রম ও সস্তা সম্পদের যোগান ধরার বাধ্যবাধকতা।

আর শাসকের সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের পেছনে আসল রহস্য হচ্ছে বিরোধী শিবিরের ভূমিকা ও “সুশীল সমাজের” বিভ্রান্তি। বিরোধীরা পুঁজির মালিককে অসন্তুষ্ট করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিসরে নির্বাচনী রাজনীতি করতে অক্ষম। ফলে রাষ্ট্রের আচরণের ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র” মত। এমনকি বাম-বিরোধী শিবিরের একাংশেরও এই প্রবণতা ক্রমশঃ প্রকট হচ্ছে। সম্প্রতি সিপিএম দল কেরালা সরকারের ভূমিকার উপর সিলমোহর লাগাতে নতুন এক নীতিগত অবস্থান নিয়ে ব্যক্তি-পুঁজির গুরুত্ত্বকে সমাজবাদী গঠন প্রক্রিয়ার বাস্তবতার অঙ্গ হিসাবে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তের কী অর্থ? রাষ্ট্রীয় মালিকানার অর্থ যে সমাজবাদ নয়, সেটা সবাই স্বীকার করে, কিন্তু সেটি অবশ্যই একটি  প্রয়োজনীয় শর্ত – আবার ব্যক্তি-মালিকানা হলেই যে তা সমাজবাদী শ্রেণিসংগ্রামের দ্বারা প্রভাবিত হবে না সেরকম কোন স্বতঃসিদ্ধ নিয়মও কেউ ঘোষণা করেনি। কিন্তু নেহেরু-ইন্দিরা জমানায়, সিপিএম রাশিয়া থেকে আবিষ্কার করল যে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সমাজবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এবার বাজপেয়ী – মোদী জমানায় চিন থেকে আবিষ্কার করল ব্যক্তি-মালিকানা সমাজবাদী গঠন-প্রক্রিয়ার অঙ্গ। প্রথমটি ছিল রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের কাছে আত্ম-সমর্পণ, দ্বীতিয়টি নিওলিবারেলিজমের কাছে।  

অ-বাম বিরোধী শিবিরের দুর্বলতা আরও এককাঠি উপরে। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে “রাষ্ট্র-সর্বেসর্বা” করার যে আইনি আয়োজন চলছে, তাতে প্রাথমিকভাবে টার্গেট মুসলমানরা। কারণ, তারা মূলত কৃষিজীবী, তারা মূলত দক্ষ কায়িক-শ্রমিক, তারা সংখাগুরু ধর্মের কাছে মূল অপর ধর্ম। ফলে বিরোধীরা রাষ্ট্রের ভূমিকার বিরোধিতা করতে গিয়ে সেই আশঙ্কায় ভোগেন যে, সংখ্যাগুরুর ভোট না হাতছাড়া হয়, যদিও সেই আশঙ্কাকে গুরুত্ত্ব দিয়ে তাদের বিশেষ প্রাপ্তি ঘটেনি। কিন্তু শাসকরা তাতে মেজোরিটির সামাজিক স্বীকৃতি লাভে সফল হয়েছে, প্রথম পর্যায়ের বিজয় হাসিল করে নিয়েছে। সেই স্বীকৃতির জোরেই এবার এই নীতি প্রসারিত হচ্ছে অমুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের উপর। কিন্তু তার সার্বিক বিরোধিতার নৈতিক অবস্থান খুইয়েছে বিরোধী শিবির।

অতি-ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অতিমানব রাজনেতা তৈরি হয়। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সাথে ব্যক্তিক্ষমতারও কেন্দ্রীভবন ঘটে। অসমে কংগ্রেস শিবির সেখানে চ্যালেঞ্জ জানাতে গৌরব গগৈকে হাজির করেছেন। সেখানে ব্যক্তি-ইমেজ ভাঙাগড়ার রাজনৈতিক নাটক অব্যাহত আছে। কিন্তু শাসক শিবির তার দলের নির্বাচনী নেতৃত্বের ইমেজ-বিল্ডিংকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যেখান থেকে সাধারণ জনগণ ভাবতে শুরু করে যে ব্যক্তি নিজেই আইন।

অথচ সাধারণ জনতাই নির্বাচনে ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক। পুঁজির শোষণ, তথাকথিত উন্নয়নের যাঁতাকল, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত সাধারণ ক্ষোভিত মানুষ সমাধান চাইছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। কিন্তু সর্বশক্তিমানের কাছে, ভাষা-ধর্মের মধ্যবিত্ত অপর সৃষ্টির রাজনীতির কাছে মানুষ তখনই আত্মসমর্পণ করে, যখন বিকল্প কোন সচেতন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পরিসর অনুপস্থিত থাকে। যে রাজনীতি অমানবিক পুশব্যাককে আইনি বৈধতা দেয়, এবং অমানবিকতাই রাজনৈতিক ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা হিসাবে মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়, তাকে প্রতিহত করতে পারে রাজ্যব্যাপী বিকল্প ভাবনার সামাজিক জাগরণ ও রাজনৈতিক আর্টিকুলেশন।  

বিরোধী শিবিরের সেদিকে বিশেষ নজর নেই, তারা চাইছেন মানুষের ক্ষোভ, মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার নেতা এবং দুর্নীতির ইস্যুতে নির্বাচন লড়ে নিতে। কারণ তারা জানেন, যে দল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে সেই দলকেই কর্পোরেট পুঁজি মদত দেবে যদি বিনিময়ে তাদের স্বার্থ দেখা হয়, এই ব্যাপারে বিরোধী শিবির বিজেপি’র নীতি থেকে খুব বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন না। অসমের এক বড় সংখ্যক ভোটার চা-শ্রমিক, সেই শ্রমিকদের অধিকারের বিষয় উত্থাপনে নরম-হিন্দুত্বের রাজনীতিও ত্যাগ করতে হয় না, তথাপি চা-শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্নে নীরবতা রহস্যজনক। ফলে হার-জিতের খেলা চলছে ধ্বংসের আঙিনায়।                 

সমগ্র বিশ্বে এক ধ্বংসের আবহ বিরাজ করছে। ভারত তথা অসম কোন ব্যতিক্রম নয়। তথাপি অসম সেই মানদণ্ডেও এক বিশেষ উল্লেখ দাবি করে। মিথোলজির আধুনিক ধ্বংসের পুনর্ণির্মাণ।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় একই সময় প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠার ঊষালগ্ন। ইতিহাসবিদরা এই প্রাচীন সময়কে কো-অ্যাক্সিয়্যাল পিড়িয়ড বা একই-অক্ষের সময়কাল হিসাবে চিহ্নিত করেন। প্রাচীন সভ্যতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্ব ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে হতবাক হওয়া অনুসন্ধিৎসা। এর থেকেই জন্ম নেয় মিথোলজি’র দেবতাদের। ভারত গ্রিক সহ প্রায় সভ্যতাতেই মিথোলজির কাহিনীর সাযুজ্য রয়েছে। দ্বেষ, হিংসা, ক্রুরতা, ক্ষমতা লড়াইয়ের ভরপুর অসংখ্য দেবতা ও মিথোলজির চরিত্রে। আর এই চরিত্রগুলিই সৃষ্টির প্রতীক।

প্রেম, যুদ্ধ সব মিলিয়ে বারজন গ্রিক অলিম্পিয়ান দেবতার প্রধান জিউস। সৃষ্টির শুরুর সময়ের দেবতা হিসাবে আকাশ অথবা স্বর্গের স্বৈরশাসক ইউরেনাস ও পৃথিবী গায়া’র এক সন্তানের নাম ক্রোনাস। মাতা গায়া’র নির্দেশে ইউরেনাসের মিলনের সময় তাঁর পিতাকে হত্যা করে ক্রোনাস আকাশের দখল নেয়। ক্রোনাস তার বোন রায়াকে বিবাহ করে। কিন্তু মৃত্যুকালে তাঁর পিতা ভবিষদ্বাণী করেনে যে ক্রোনাসের মৃত্যু হবে তাঁর সন্তানের হাতে, সেই ভয়ে রায়া’র কোলে জন্মের সাথে সাথেই একে একে পাঁচ সন্তানকে সে খেয়ে ফেলে। ষষ্ঠ সন্তানকে রায়া গোপনে রক্ষা করে। সেই ষষ্ঠ সন্তান যখন তার পিতার সামনে হাজির হয়, তখন পিতার পেট থেকে বেরিয়ে আসে আগের পাঁচ সন্তান। তাদের এই নবজন্মের জন্য ষষ্ঠ সন্তান জিউস জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে টাইটানদের পরাজিত করে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালের সম্রাট হয়ে বাকী পাঁচ ভাইকে বিভিন্ন ক্ষমতার অধিপতি হিসাবে নিয়োগ করে। এতে তার মাতামহ ও পিতামহ সহযোগিতা করেন। এভাবেই অন্যান্য ক্ষমতার দেবতা হিসাবে আরও ছয় জনকে নিয়োগ করে।

এথেনার জন্মও চিত্তাকর্ষক। জ্ঞানী ও গুণী অলিম্পিয়া-পূর্ব টাইটান দেবী ম্যাটিস জিউসের পরামর্শদাতা, আবার তাদের মধ্যেও ভালবাসার আকর্ষণ রয়েছে। দেবতাদের এক বিবাহ অনুষ্ঠানে জিউস বিভিন্ন রূপে ম্যাটিসের পেছনে ধাওয়া করে, ম্যাটিস পাহাড়ের ছোট গর্তে ঢুকে গেলে সাপ হয়ে ভেতরে গিয়ে ম্যাটিসকে জড়িয়ে ফেলে। জিউস আদর করে দাবি করে যে জিউস ম্যাটিস থেকে বেশি বুদ্ধিমান সেটা প্রমাণিত হলো। প্রত্যুত্তরে ম্যাটিস বলে যে সে যদি ধরা দিতে চাইত না, তাহলে জিউস তাকে ধরতে পারত না। সেটা পরীক্ষা করতে ম্যাটিস ফড়িং সেজে গলিয়ে বেরিয়ে গেলে জিউস গিরগিটি রূপে ম্যাটিসকে গিলে ফেলে। এরপর ম্যাটিসের প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়। ব্যাথার উপসম না হলে ভেতেরে কী আছে তা দেখতে জিউসের মাথা দু’ভাগে কাটলে বেরিয়ে আসে জিউসের কন্যা অতীব রূপসী ও গুনবতী দেবী এথেনা। এভাবে বিশ্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের পরিচয় ঘটার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মিথোলজির দেবতা ও চরিত্র বাড়তে থাকে।

এবার ধ্বংসের পালা। সর্বময় ক্ষমতার অধিকর্তা হিসাবে হাজির রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী রাজনেতা। পরামর্শদাতা দানব পুঁজির প্রেমে পেছনে ছুটতে ছুটতে জল, জমিন, জঙ্গল সব ধ্বংস করে নিচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে মানুষের জীবন জীবিকা। বদলা নিতে উত্তপ্ত হচ্ছে ধরিত্রী। ধ্বংস, যুদ্ধ, তাণ্ডবের দেবতারা জেগে উঠছেন। পৌরানিক মিথোলজির মত সৃষ্টির ক্ষমতা আর দেবতাদের হাতে নেই।  সৃষ্টি, সৌহার্দ্য, শান্তির দূতরা লুকিয়ে আছে মেহনতি জনতার মধ্যে। ধ্বংসের দেবতাদের মধ্যে লড়াইয়ের আবহেই জাগিয়ে তুলতে হবে মেহনতি জনতার সামাজিক শক্তিকে। প্রাচীন মিথোলজিতে ছিল দ্বান্দ্বিকতা – সৃষ্টির জন্য ধ্বংস, প্রেমের জন্য ঘৃণা, ভালবাসার জন্য যুদ্ধ। এবার শুধু ধ্বংসের একমাত্রিকতা, সৃষ্টি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইছে, সেই বিচ্ছিন্নতাই মেহনতির নতুন লড়াই সৃষ্টির নতুন দ্বান্দ্বিকতায়।                    

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন