বিশেষ অধিকার (অনু গল্প)

Posted by স্বাভিমান Labels: ,



           আকাশে মেঘ জমেছে, পথ নিরিবিলি; সব চুপ; সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের পহর। পথের মোড়ে একটি বাড়ির নিচের ঘরে জানালায় আলো জ্বলছে; কাছে এসে চোখ তুলে তাকাতেই জানালা বুজে গেল। বন্ধুদের আড্ডায় এভাবেই বলতে শুরু করল সুমিত। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এই গূঢ় পদ্য-মুহুর্তের সূচনায় হতাশ হল, কেউ আবার হাটের রচনার কোন লঘু পর্ণ-মুহুর্ত কল্পনা করে উৎসুখ হয়ে উঠল। সবাই যখন ভাবছে সুমিত এবার বন্ধ জানালার ভেতরে প্রবেশ করবে, সুমিত কিন্তু তার বাচনে এক রহস্যের বুনোট বুনতে লাগল। সুমিত বলতে লাগল, সত্যি এ এক ভয়ঙ্কর মুহুর্ত। উপরে ঘনকালো মেঘলা আকাশের গাড় অন্ধকার ও নিচে রাস্তার দু’পাশে মিউনিসিপালটির নিয়নের বাতির স্নিগ্ধ আলো – উলম্ব এই স্পেসের মাঝখানে আমি তেতলা বাড়ির ছাদের আবছায়ায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে আকাশ আলোয় ঝলসে উঠল, একই সাথে নিভে গেল নিয়নের বাতি। ক্ষণিকের এই বৈপরিত্যের ঘোর কাটতে না কাটতেই চরাচর ঘন আঁধারে ডুবে গেল, রাতের পাহাড়ে এক গভীর গুহার মধ্যে একা বাসের অনুভূতিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি ফিরে গেলাম ঘরে।

             আমি প্রতিরাতে একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ে এই ছাদে এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম। যে এলাকায় আমি ভাড়াঘরে থাকতাম সেই এলাকায় ক্রমশ ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ দু-তিনতলার বাড়ি, পাহাড়ের শৃঙ্খলা মেনে রাস্তাটি যখন আবার উপর দিকে উঠে গেছে তখন অন্তত নাম-ঠিকানায় আরেকটি এলাকা শুরু। রিসার্চ স্কলার হিসেবে একটি প্রজেক্ট নিয়ে এই পাহাড়ি রাজ্যে আমাকে যেতে হয়। ক্রমশ এই পাহাড়ি রাজ্যের মোহনীয় প্রাকৃতিক শোভা ও সহজ সরল মানুষদের প্রতি আমি এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করতে থাকি, বিশেষ করে আমার বাড়ির রাস্তার বিপরীত বাড়ির তেতলার জানালার পাশে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যে মেয়েটি গভীর রাত অবধি বসে থাকত সেই মেয়েটির প্রতি। ময়নামতির পথের ধারে পটলচেরা কাজলনয়নী যেমন কবিকে আকর্ষিত করে, এই পাহাড়ি ঢালু পথের ধারে লঙ্কাচেরা চোখের মুখাবয়বের রূপ-লাবণ্য আমাকে অনুরূপভাবে আকর্ষিত করতে থাকে। ঢালু পথের বাঁকে আমি কতবার তার সামনাসামনি হয়েছি, কিন্তু কথা বলার সাহস জোটাতে পারিনি। এটা শুধু একারণেই নয় যে, আমি মুখচোরা প্রকৃতির ছেলে ছিলাম বলে। বরঞ্চ কথা বলার সাহস জোটাতে না পারার মুখ্য কারণ ছিল যে, পাড়ার মোড়ে বা রাস্তায় মোটরবাইকে যে উঠতি ছেলেছোকরারা ঘুরে বেড়াত তারা জানত আমি মায়াং অর্থাৎ বিদেশি। মায়াং হয়ে কথা বলার প্রচেষ্টার অন্য অর্থ দাঁড়িয়ে যাওয়ার বিপদকে অবজ্ঞা করার সাহস আমার ছিল না।

              সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। মাঝে মাঝেই দূরে পূব-আকাশের পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি মেরে রোশনাই ছড়িয়ে সূর্য ঘন মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছিল। সকাল দিকে দু’এক পশলা বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢালু পথের কালো চিকচিকে স্যাঁতস্যাঁতে কিন্তু মনমাতানো রূপ বেরিয়ে পড়েছিল, যেন পাহাড়ের গা বেয়ে মাথায় বোঝা নিয়ে নামতে থাকা কোন সাঁওতালি-মুণ্ডারি আদিবাসী রমণীর ঘর্মাক্ত গাল।

              পাহাড়ি রাজ্যের মেঘলা সকালের এই আমেজের সুর কেটে দেয় বাতাসে ভেসে আসা এক তীব্র কলরব। জানালা দিয়ে রাস্তায় উঁকি মেরে দেখি এক বড়সড় মিছিল এই পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সামনের ব্যানারে কী লেখা রয়েছে তা ভাষা না জানার জন্য পড়তে পারিনি। কিন্তু একি, ব্যানারের এক প্রান্ত ধরে রয়েছে আমার উলটো দিকের বাড়ির সেই মেয়েটি। পেন্টে পা-ঢুকিয়ে, জামা গায়ে গলিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি। দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যানারের কিছু পেছনে মিছিলে ঢুকে পড়ি। দৌড়তে গিয়ে হাঁফিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা ধাতস্ত হওয়ার আগেই দেখি সামনে বিশাল পুলিশ ব্যারিকেড, ঘাবড়ে গিয়ে যতটা সম্ভব সবার অলক্ষ্যে মিছিলের পেছন দিকে চলে আসি। পুলিশ মিছিলকে রাজভবনের দিকে যেতে দেবে না, কিন্তু মিছিলের নেতৃত্ব নাছোড়বান্দা। সেই মেয়েটিও যে সেই নেতৃত্বের একজন তা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি। আচমকা মিছিলকারীদের উপর পুলিশের বেধড়ক লাঠির ঘা যথেচ্ছভাবে আছড়ে পড়তে লাগল। সেই মেয়েটির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেও ঘটনার আকস্মিকতার রেশ কাটতেই আমার বাস্তববোধ জাগ্রত হয়ে উঠল। আমার রিসার্চের এমন রসদ হাতছাড়া করা যায় না। পকেট থেকে হাতের মুঠোর সাইজের স্লিম ডিজিট্যাল ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে লাগলাম। সরকারি তথ্যপাতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সারাদিন অফিসে অফিসে দৌড়ঝাপ করে বেশকিছু অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করলাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বেলা কখন ঢলে পড়ে আবছা অন্ধকার ছেয়ে গেছে তা ঠাহর করতে পারিনি। রাতের খানা হোটেলেই সেরে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।

             বাড়ির সামনে এসে উপরের দিকে তাকাতেই জানালা বন্ধ হয়ে গেল, নিভে গেল আলো। যথারীতি সিগেরেটে আগুন ধরিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম, জানালা বন্ধ রইল – ভেতরে অন্ধকার থাকায় কিছুই দেখার জোঁ ছিল না। ভগ্নমনোরথ হয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভোরের দিকে তীব্র চিৎকার, গাড়ির ইঞ্জিনের ঘরঘর আওয়াজ, হৈ-হুল্লোড়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সামনের রাস্তায় সেই মেয়েটির বাড়ির সামনে বিরাট জটলা। নিচে নেমে গিয়ে দেখি পুলিশ-মিলিটারিতে সমস্ত পাড়া ছয়লাপ। পুলিশের গাড়ির সাথে একটি অ্যাম্বুলেন্সও দাড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে বাড়ির কাছে যেতেই দেখি ক’জন লোক কাঁধে ও পায়ে ধরাধরি করে মুখ ছাড়া বাকি অংশ চাদরে মোড়ে একটি দেহ সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনছে। মুখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি, মুখাবয়বে সর্বত্র বাহিনীর বিশেষ অধিকার প্রয়োগের ছাপ জ্বলজ্বল করছে। তৎক্ষণাৎ আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠে। মবাইলের স্কিনে লেখা গাইড-স্যার। কোনমতে বলি, “স্যার, অমার রিসার্চের কাজ সবে শুরু”। মোবাইলের স্যুইচ অফ করে দিই। ছাদে যাওয়ার আগে রাস্তা থেকে উপরের দিকে তাকানো এবং জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া – সময়ের এই অদ্ভূত সংযোগ যদি না ঘটত তাহলে পরিস্থিতির কি কোন ইতরবিশেষ ফারাক ঘটত? – এই প্রশ্ন আমাকে আজকের ব্যস্তসমস্ত নাগরিক জীবনের অবসরেও তাড়া করে বেড়ায়।

(c) Picture:ছবি

পরিচয় (অনুগল্প)

Posted by স্বাভিমান

পরিচয় (অনুগল্প)

আমি সুদেব, সুহেল নই। সুহেল আসছে পরে। একটু পেছনে পড়ে গেছে। পড়বেই তো, সে যে সুহেল। দু’জনের হৃদযন্ত্রটা বা দিকে, মরফোলজি-হিস্টলজিও এক – কিন্তু আমি সুদেব, সুহেল নই। লেভিসের জিন্সটা খুলে ফেল, এবার এডিডাসের জাঙ্গিয়াটাও নামাও বাছা – এবার সুহেলকে চেনা গেল। গুয়েন্তানামোতে তো এভাবেই সুহেলদেরকে চিনে ফেলে। কে বলে মানুষ চেনা দায়? দূর ছাই, কী সব আবোল-তাবোল দিয়ে সময় নষ্ট। আমি সুদেব, সুহেল নই। সুহেলকে আসতে দিন, একটু ধৈর্য ধরুন। আমি সুদেব বলছি, এবার আমার কথা শুনুন।
আমি ভারতীয়। কেউ যদি আওয়াজ দেয় “গরব্ সে বলো” – আমি মনে মনে দোহার দেই। তবে জোরে বলি না, কারণ আমি তো বিশ্ব নাগরিক – ওই শ্বেতাঙ্গদের মতই উন্নত, সংস্কৃতবান। হোক না আমার গায়ের রঙ বাদামি বা দক্ষিণী কালো – ওসব পিগমেন্ট দিয়ে আমার পরিচয় জানা যাবে না। ‘নিগারদের’ মত আমার পূর্বপুরুষ তো আর দাস ছিলেন না। আমার মনের ভেতর থেকে আমার পরিচয়ের উপর ফোকাস পড়ে – যারা বোঝার তারা ঠিক বুঝে নেয়। কাদের বোঝার কথা? কেন মিছিমিছি জটিল প্রশ্ন তুলে সুর কাটছেন - আমার পরিচয়টা তো দিতে দিন। ‘আমি সুদেব, সুহেল নই’ – তার মধ্যেই তো আসলে লুকিয়ে আছে আমার পরিচয়। এই যে আমি আগে চলে আসলাম, সুহেল আঁটকে গেল – কারণটা বুঝতে পারলেন না? আমার মনের ফোকাসই আমার পরিচয়, সুহেলের তো তা নেই। আমি যে সে ভারতীয় নই – আমি সেই ভারতীয়দের বংশধর যারা কাদা মাড়ায় না, বরঞ্চ মায়ের সাথে পেটের টানে যারা কাদা মাড়ায় তাদেরকেই মাড়িয়ে দেয়, এদের পদদলিত করতে যাদের পদস্খলন হয় না আমি তাদেরই প্রতিভূএই উদর-সর্বস্বদের উপরের বা দিকের হৃদযন্ত্রটা পরিচালিত হয় উদরের প্রয়োজনে। কিন্তু আমাদের কাছে তো সেই বাদিকের যন্ত্রটিই আসল, তাই জীবনযাত্রার লটবহর ওই মুটেদের উপর ছেড়ে দিই। আমাদের উদরের দায়িত্ব ওদের, আর ওদের হৃদয়ের দায়িত্ব আমাদের। এভাবে ভাগাভাগি না হলে তো সংসার অচল। তাই তো আমরা “গরব্ সে বলি ...”। আমার হৃদয়ের এই গর্ববোধ থেকে উৎসারিত অনুচ্চারিত বার্তা সেই আমেরিকান ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে পৌঁছে যায় – আমার পরিচয় পেতে তার অসুবিধে হয় না। সেই অফিসারটা জানে আমার পরিচয় আমার অন্তরঙ্গে। দু’জনের মনের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য মিলে যায়, কারণ দু’দলই সংসারের ভাগাভাগিটা মেনে নিয়েছি। তাই আমি সুদেব, সুহেল নই। কারণ সুহেলের পরিচয় তার বহিরঙ্গে যা সে ওই ‘নিগারদের’ মতই নিজে ঠিক করতে পারে না। সুহেল আমার বাল্যবন্ধু, তাই তো তার জন্য অপেক্ষা করছি।
পরিচয়টাই যদি আলাদা, তবে বন্ধু কী করে? আবার জটিল প্রশ্ন। আরে মশাই, আপনি তো দেখছি সব গোবলেট করে দেবেন। একটু ধৈর্য ধরুন, আগে সুহেলের পরিচয়টা জেনে নিন, ততক্ষণে আমি আমার হৃদয়-পথে একবার পরিক্রমা করে আসি। আমাকে তো আবার আসতে হবে – সুহেলকে নিয়ে যেতে হবে না! – সুহেল যে আমার বন্ধু।
সুহেলের পরিচয় আর সুহেলকে দিতে হয় না। মাইকে ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে সুহেলের পরিচয়। সুরেলা কণ্ঠে একই লাইন বারবার বলা হচ্ছে – “Suheluddin Ahmed alias Subbed Khan, a dreaded Al Qaida terrorist and a recruit from Indian Mujaheedin has been intercepted by the security agency while passing through immigration security check-out. Any relative accompanying him is directed to contact airport security outpost immediately.”  সুদেবের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে, হৃদযন্ত্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম করে। বাল্যবন্ধুকে নিয়ে যাবেন না? আবার বেয়াড়া প্রশ্ন। সুদেব ক্রোধ চাপা দিয়ে বলে ওঠে “তাতে আপনার এতো আগ্রহ কেন মশাই?” “আপনার অন্তরের পরিচয়ের জোরটা সুহেলের কোন কাজে লাগবে না?”। সুদেব কোন যুতসই জবাব খুঁজে পায় নাসুহেল যে তার সঙ্গী সুদেবের কথা পুলিশকে বলেনি তা মাইকের ঘোষণা থেকেই সুদেব বুঝতে পারে। সুহেল তো তার সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারত, কারণ প্রবাসী বন্ধু সুদেবের উপর ভরসা করেই তো সে এখানে এসেছে। সুহেলের জন্য তদ্বির করার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না সুদেব।
বুকের বা দিকে যে গর্বের পরিচয়কে সে বহন করে চলেছে, আজ তাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রবৃত্তি হয়। এক হীনমন্যতাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেফ্ল্যাটের দরজায় স্যুইচের বোতামে চাপ দিতেই কলিং বেলের কর্কশ আওয়াজ তার বিরক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। দায়সারাভাবে স্ত্রীর সব প্রশ্নের জবাব দেয়, মাঝেই মাঝেই চাপা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। রাতের যৌনমিলনে এই প্রথমবার সে এমন হিংস্র হয়ে উঠে যে তার মেমবিবি প্রতিবাদ করে এবং রিসিভার উঠিয়ে হেল্পলাইনে খবর দিয়ে দেয়। রাতের আঁধারে পুলিশ ভ্যানে তার বহিরঙ্গের পরিচয় তাকে তাড়া করে, অফিসারের কাছ থেকে সুহেলের সন্ধান পেতে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এবার বলো বাপু তোমার আসল পরিচয়টা? এবার সুদেব বিরক্ত হয় না। সে চাঁপা সুরে বলে উঠে – আমি সুদেব, আবার সুহেলও বটে।  
               

নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন ও এনরেগা আন্দোলন

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,



                                 অরূপা মহাজন
                              (অরুণোদয়ের জন্য)
উনিশ শতকের উদারবাদ

       ‘নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন’ – ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার না করলে এই শব্দবন্ধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। উনিশ শতিকার উত্থানোন্মুখ শ্রমিক শ্রেণি ও বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় পুঁজির সম্প্রসারণের পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণি ও পুঁজির মধ্যে এক সমঝোতা গড়ে ওঠে। পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হলেও শ্রমিকশ্রেণির সামাজিক সুরক্ষা, ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক দলের অধিকারের পক্ষে রাষ্ট্র ভূমিকা নিয়েছে। বাজারে পুঁজিমালিক বা শিল্পমালিকদের উৎপন্ন সামগ্রীর চাহিদা তৈরির ক্ষেত্রে এই শ্রমিক শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার বিশেষ ভূমিকা থেকেছে। পুঁজি ও শ্রমিকের এই সহাবস্থানের পরিস্থিতিতে বিশ্বায়িত পুঁজির পক্ষে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ভূমিকাকে উদারবাদ হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে। এই উদারবাদ একদিকে শ্রমিক শ্রেণির কিছু সুবিধা আদায়ের পর্যায়কে যেমনি চিহ্নিত করে, ঠিক তেমনি শ্রমিক শ্রেণির পরাজয়কেও সূচিত করে। কারণ সর্বহারা শিল্প শ্রমিকদের আবির্ভাবের সাথে সাথে এটা আশা করা হয়েছিল যে শ্রমিক শ্রেণি মানব সমাজের সাধারণ স্বার্থকে বহন করবে এবং শ্রেণিশাসন ও শোষণের অবসান ঘটবে। সে বিচারে উনিশ শতকের উদারবাদ পুঁজির স্বার্থেই একধরনের শ্রেণিসমঝোতা।
শ্রেণি-সমঝোতার কাঠামোর পতন ও নয়া-উদারবাদ

                     কিন্তু সত্তরের দশকের মুদ্রাস্ফীতির সংকটের চাপে এবং রাষ্ট্রকে নিজেদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার মত ক্ষমতাধর বৃহৎ ওলিগোপলিদের (মনোপলি বা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের গ্রুপ) আবির্ভাবের ফলে এই শ্রেণি সমঝোতায় ফাটল দেখা দেয়। শিল্পশ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতার বাড়বাড়ন্ত যেমনি উদারবাদী নীতিকে নির্ধারণ করেছে, ঠিক তেমনি উদারবাদের পতনের মাধ্যমে যে নতুন পরতিস্থিতির উদয় হয়েছে সেটাও নির্ধারিত হয়েছে এক নতুন শ্রেণির শক্তি সঞ্চয়নের মধ্য দিয়ে, সেই নতুন শ্রেণিটি হচ্ছে বিত্তীয় শ্রেণি। লেনিন বর্ণিত পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপে শিল্পপতিরা বিত্ত বা ফিনান্স পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করত ও নিজেদের স্বার্থে লগ্নি করত। বর্তমান পর্যায়ে ব্যাপক ও সুগঠিত ঋণ-কাঠামো এবং বিত্ত-বাজারে লগ্নি করার বিস্তৃত সব নব্য-প্রকরণের মাধ্যমে বিত্তপুঁজির নিজস্ব বিত্ত-বাজারে বিত্তীয়-ওলিগোপলিস্টদের আবির্ভাব ঘটেছে এবং এই ওলিগোপলিস্টরা রাষ্ট্রীয় নীতিকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবান্বিত করে এই বাজারকে সচল রাখার পক্ষে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে এবং শ্রমিক তথা আম-জনতার যেটুকু অধিকার উদারবাদের পর্যায়ে স্বীকৃত ছিল সেই অধিকার তথা সামাজিক-সুরক্ষার কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। পুঁজিবাদের বর্তমান এই পর্যায়কেই নয়া-উদারবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উদারবাদী বা নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন আসলে পুঁজির বিশ্বায়ন, শ্রমের বিশ্বায়ন নয়। বর্তমানে পুঁজির এই বিশ্বায়নের গতি অনেক অনেক গুণ তীব্র, কারণ জনস্বার্থে জাতিরাষ্ট্রের যেটুকু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পূর্বে ছিল তা এই পর্যায়ে অনেকখানি ক্ষীয়মান।
বাজারের চাহিদা ও নয়া-উদারবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া

              কিন্তু একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন পাঠকের মনে উদয় হওয়া স্বাভাবিক। উনিশ শতকের উদারবাদের পরিস্থিতিতে শিল্পমালিকদের উৎপাদনের মেশিনকে সচল রাখার জন্য উৎপন্ন সামগ্রীর উপভোক্তা হিসেবে শ্রমিক শ্রেণি যে চাহিদা তৈরি করেছিল, শ্রমিকশ্রেণি তথা আম-জনতার অবনমনের নয়া-উদারবাদী পর্যায়ে পুঁজিমালিকদের জন্য বাজারের প্রয়োজনীয় চাহিদা কারা এবং কীভাবে তৈরি করছে? বিত্ত-বাজারে শেয়ার, বণ্ড, সিকিউরিটির মত পণ্যের কেনাবেচাকে সচল রাখতে আমেরিকার মত পুঁজির কেন্দ্রের বাজারে ঢালাও ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, এমনকী জনগণের যে অংশ ঋণ ফেরত দিতে সক্ষম নয় তাদেরকেও ঋণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। যে এসেটের জন্য ঋণ দেওয়া হয় সেই এসেটের দামের ক্রমাগত বৃদ্ধি ঘটায় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ ফেরত দেওয়ার আস্থা জন্মে এবং ঋণদাতাদেরও আস্থা জন্মে বন্ধক হিসেবে এই এসেটের দাম বৃদ্ধির ফলে। ঋণ প্রদানে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলি এই বন্ধকী সম্পত্তির উপর ভিত্তি করে সিকিউরিটি সার্টিফিকেট তৈরি করে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে ঋণপ্রদানের অর্থ আদায় করে এবং এই সিকিউরিটি সার্টিফিকেটগুলো বিত্ত বাজারে ব্যাপক কেনাবেচার মাধ্যমে মূল সম্পত্তির কৃত্রিম মূল্যের এমন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি ঘটে যে প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করা মুস্কিল হয়ে পড়ে এবং এভাবে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে এক একটা ফানুস বা বুদবুদ তৈরি হয়। যে কোন কারণে বাজারে অনাস্থা তৈরি হলে এই বুদবুদগুলি ফেটে গিয়ে বাজারে পুঁজির বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় এবং বিষাক্ত এসেট হিসেবে পরিগণিত এই সিকিউরিটি সার্টিফিকেটগুলো আর কেউ কিনতে রাজী হয় না, ঋণগ্রহীতারা ঋণ ফেরত দিতে অপারগ হয়ে ওঠে এবং মূল মর্টগেজ সম্পত্তির মূল্য একেবারে তলানিতে চলে যাওয়ায় এগুলো বাজেয়াপ্ত করে ঋণদাতাদের কোন ফায়দা হয় না। তখন “ফার্মগুলি এতো বিশাল যে এদেরকে মরতে দেওয়া যায় না”- এই যুক্তির আড়ালে সরকার জনগণের অর্থে এই বিষাক্ত এসেটগুলো ক্রয় করে কোম্পানীগুলোকে বাঁচিয়ে দেয় এবং আরেকটি নতু্ন সম্পত্তিতে এধরনের ঋণের মাধ্যমে ‘সম্পত্তি বুদবুদ’ তৈরির প্রক্রিয়া সূচনা করে। এভাবেই ‘ডটকম বাবল” “হাউজিং বাবল” ইত্যাদি গড়ে উঠেছে এবং সঙ্গত কারণে ফেটেও গেছে। পুঁজির কেন্দ্রে এভাবে যখন বিত্তবাজারের চাহিদা তৈরির প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, তখন ভারতবর্ষের মত প্রান্তিক দেশগুলিতে কাঠামোগত পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিত্ত-বাজারের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত শিথিল করা হচ্ছে এবং শিল্পায়নের এমন এক নীতি অনুসরণ করতে সরকারগুলিকে বাধ্য করা হচ্ছে যেখানে শৌখিন সামগ্রীর চাহিদা তৈরির জন্য জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশের আয় বৃদ্ধি ঘটছে।
ভারতবর্ষে উদার-আর্থিক নীতির প্রভাব

           ১৯৮০ সালে ভারত সরকার বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে এক বিশাল পরিমাণের ঋণ নেয় এবং এই ঋণের সর্ত হিসেবে কাঠামোগত পুর্ণগঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানীর স্বার্থে এবং নির্দেশে সরকারী নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়া চালু করে এবং আম-জনতার সামাজিক ও আয়ের সুরক্ষার সমস্ত সরকারী নীতি ও ভর্তুকী প্রদানের সব সরকারী বন্দোবস্ত একে একে বাতিল করতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং এই নয়া-উদারবাদী আর্থিক নীতিতে সরকারী অফিসিয়্যাল সিলমোহর লাগিয়ে দেন। আধুনিক বিলাস সামগ্রী তৈরির জন্য শিল্পপতিদের জমি প্রদান সুনিশ্চিত করতে উপনিবেশিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষক উচ্ছেদ, পুঁজিপতিদের সস্তায় প্রাকৃতিক সম্পদ যোগানের জন্য সংখ্যালঘু-অবিসি-দলিত-জনজাতীয়-আদিবাসী উচ্ছেদ, উন্নয়নের নামে ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পরিবেশ দূষণ ও জনগণকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর আমদানী উপর নির্ভর করে রপ্তানী নীতি নির্ধারণ করার ফলে রপ্তানী আয় থেকে আমদানীর ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটানো, বিত্তপুঁজির ফাটকা বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষিত করতে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দেওয়া, বিত্ত ও শিল্পবাজারে চাহিদা তৈরির জন্য জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশের আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া। এই পদক্ষেপগুলিই হচ্ছে উদারবাদী অর্থনীতির এমন এক বিকাশের মডেল যেখানে বিকাশের হার বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা হয় অসাম্য ও আমজনতার দুর্দশা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং এই মডেলের প্রবক্তাদের আপ্তবাক্য “বিকাশের লাভ চুঁইয়ে চুঁইয়ে নীচের দিকে যাবে ও আমজনতা লাভবান হবে” – কে অসাড় প্রমাণিত করে।
অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ

               সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানার নির্মাণের প্রস্তাবে টাটা’র ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে সরকারের ৮৫০ কোটি টাকা ভর্তুকীর প্রস্তাব ছিল। সিঙ্গুরের কৃষকদের প্রতিরোধ এবং গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আরও লোভনীয় প্রস্তাবের ফলে টাটা গুজরাতে সেই কারখানা নির্মাণ করে। এভাবে ‘সেজ’ কিংবা ‘সেজ’-বহির্ভুত ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্পপতিদের বিশাল অংকের ভর্তুকী দিয়ে চলেছে সরকার, অথচ অন্যদিকে আমজনতার ব্যবহার্য নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপর ভর্তুকী তুলে দেওয়ার সরকারী পদক্ষেপকে সরকার, দল ও নেতৃত্বের সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। অবশ্য জনগণ তাদেরকে যেদিন কড়া জবাব দেবে সেদিন তার সম্মুখীন হওয়ার জন্য তাদের বুকের পাটার সত্যিকার পরীক্ষা হবে। এই প্রক্রিয়ার ফলে শতকোটীপতিদের সংখ্যা ২০০৪ সালে ৯ থেকে ৪০-এ বৃদ্ধি ঘটে যা জাপান, ফ্রান্স, ইতালি, চিনের তূলনায় অনেক বেশি এবং আমেরিকার ঠিক নীচে। উপরের এক ক্ষুদ্র অংশের বর্ধিত বেতন ও অন্যান্য সুযোগের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনের দৈনিক ক্রয়ক্ষমতা ২০ টাকারও কম। ফলে এই আমজনতা বাজারে বিশেষ কোন চাহিদা বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে না। যেহেতু যোগান ও উৎপাদন চাহিদার উপর ভিত্তি করে স্থির হয়, তাই উচ্চআয়ের ক্রেতাদের ব্যয় করার ক্ষমতা এবং ‘ইনকাম ইলাস্টিসিটি অব ডিমাণ্ডের’ নিয়ম মেনে আয় বৃদ্ধির চাইতেও বেশি চাহিদা বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে তাদের প্রয়োজনীয় বিলাসী সামগ্রীর যোগান ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিক্রির জন্য মল, সুপার-মার্কেট ইত্যাদি করা হচ্ছে এবং আমজনতার প্রয়োজনীয় নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদনে কোন রকমফের হচ্ছে না। উচ্চআয়ের লোকদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম যখন কমছে, তখন নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি ঘটছে। এধরণের চূড়ান্ত অসাম্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কোম্পানীর দখলদারির জন্য ভিটেমাটিছাড়া হওয়ার খাড়া ঝুলছে নিপীড়িত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলোর উপর। এটা এরকম এক পরিস্থিতি যা দরিদ্র-পিছিয়েপড়াদের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক স্থিতি গোটা দেশের উপনিবেশিক স্থিতিকে আরও শক্তিশালী করছে। জনগণ এরকম পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এখানে ওখানে স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ করছে, যদিও কোন বিকল্প সংগঠিত শক্তির দেখা এখনও মেলেনি। এই বিদ্রোহ মোকাবিলায় এবং নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার তাড়নায় নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়নে বিশ্বাসী সরকার ও বিভিন্ন দল অনেক কদম এগিয়ে গিয়েও মাঝে মাঝে এককদম পিছিয়ে গিয়ে গণস্বার্থে পদক্ষেপ নেয়। এনরেগা জারি করা সেরকমই একটি পদক্ষেপ।
এনরেগার আন্দোলন ও নয়া-উদারবাদের বিকল্প

                  এনরেগার মাধ্যমে যদি গ্রামীণ জনগণ ও শহরের বস্তি ও ঝুপরিবাসীদের সবাইর রোজগারের বন্দোবস্ত করতে এবং তাতে যে গণ-চাহিদা তৈরি হবে তার উপযোগী শিল্পোৎপাদনের নীতি গ্রহণ করতে সরকারকে যদি বাধ্য করা যায়, তাহলে নয়া-উদারবাদী ফ্রেমওয়ার্ক থেকে পিছু হটার জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে যে এনরেগার বিধান অনুযায়ী সবাইকে কাজের গ্যারান্টী প্রদান করতে হলে এনরেগার জন্য মোট জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ৬-৭% বাজেট বরাদ্দ করতে হয়, বর্তমানে যা মাত্র জিডিপি’র ১%। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর নির্দেশানুসারে জারি করা ফিনান্স রেগুলেশন ও বাজেট ম্যানেজম্যান্ট আইন, ২০০৩ বলবৎ থাকা অবস্থায় এই বৃদ্ধি সম্ভব নয়, কারণ এই আইন অনুসারে আর্থিক ঘাটতি কমানোর জন্য নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপর ভর্তূকী ও আমজনতার জন্য ব্যয় কর্তন করতে হয়। উপরন্তু এই সংস্থাদ্বয় ইতিমধ্যেই এনরেগার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে। সুতরাং এনরেগার পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত এই আইন বাতিলের এবং তার মাধ্যমে বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রিত সংস্থাদ্বয়ের নির্দেশ বাতিলের দাবিকে সামিল করে নিতে হবে। এভাবে আমজনতার আয়বৃদ্ধির বিভিন্ন সংগ্রামে উচ্চআয়ের ক্রেতাদের উপযোগী উৎপাদন-নীতির বদলে আমজনতার চাহিদার উপযোগী উৎপাদন নীতি গ্রহণ করার দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং এই নীতি স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারীকরণের বিপরীতে সরকারী উদ্যোগকে প্রসারিত করেই করতে হবে। এই দাবিগুলির তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব যখন নীতি-নির্ধারণে আমজনতার মতামত ও অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে গণ-ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ঢেলে সাজানো হবে। ৭৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম হলেও সংবিধানের ২৪৩ধারার বিধান অনুযায়ী পঞ্চায়েতের আর্থিক স্বশাসন প্রদান না করে পঞ্চায়েতকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য শাসনের গ্রামীণ দালাল তৈরির কারখানা বানিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রামসংসদ বা গ্রামসভা ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং কেন্দ্র-রাজ্যকে ফেডারেল কাঠামোয় পুনর্গঠন করে জনগণের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য রাষ্ট্রকে যথেষ্ট নমনীয় করা যায়। এনরেগার রূপায়ণের সংগ্রামের মধ্য থেকে নয়া-উদারবাদ বিরোধী এক বিকল্প কর্মসূচীর ভিত্তিতে এক নতুন আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। এনরেগার বিধানের পূর্ণাঙ্গ ও বর্ধিত রূপায়ণের দাবিতে আন্দোলন এভাবেই নয়া-উদারবাদ বিরোধী এক ব্যাপক কর্মসূচীর অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে এবং এভাবে এই ব্যাপক কর্মসূচীর অঙ্গ হয়ে উঠার উপর এনরেগা আন্দোলনের সফলতাও নির্ভরশীল।                                     

সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত, ‘লুক ইস্ট পলিসি’ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অস্থিরতা

Posted by স্বাভিমান

                                                          ।।    অরূপা মহাজন ।।
              
                    [এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় শিলচার থেকে প্রকাশিত অরুণোদয় পত্রিকার ২০০৮-এর আগস্ট সংখ্যায় এবং পরবর্তীতে কলকাতা ও ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত দুটি পত্রিকায় এই লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এটা এখানে তুলে দিলাম। এই প্রবন্ধটিতে   সাম্রাজ্যবাদী রণকৌশলের ২০০৮ সালে প্রাপ্ত তথ্যের অলোকে রোহিঙ্গিয়া, অন্যান্য জনজাতি সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভবিষ্যদবাণী করা হয়েছে। কিন্তু নতুন তথ্যের আলোকে এই লেখাটির পুনরায় যাচাই করার যেমনি প্রয়োজন রয়েছে, ঠিক তেমনি অভ্যন্তরিণ আধিপত্যবাদী রাজনীতির কারণ ছাড়া অন্য আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকেও বর্তমান পরিস্থিতির বিচার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতটি গড়ে উঠেছে ২০০৭-০৮ সালের আমেরিকান সাব-প্রাইম সংকটের পরবর্তীতে। পুঁজিবাদের যে কাঠামোগত সংকটের কথা অর্থনীতিবিদেরা বলছেন সেই সংকটের মধ্যেও ফিনান্সিয়্যাল মার্কেটে বিনিয়োগের মাধ্যমে যে মুনাফা ও কেন্দ্রীভবন ঘটে চলেছিল তাতে বড়রকমের ধাক্কা আসে সাব-প্রাইম সংকটের মাধ্যমে। কিন্তু রাষ্ট্রের উপর ওলিগোপলিস্টিক (মনোপলিদের গ্রুপ) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পাবলিক-প্রাইভেট ও বাজার সব স্পেসকে কর্পোরেট প্রয়োজনানুসারে পরিচালিত করে এলিট ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটিয়ে মুনাফাবৃদ্ধি ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন প্রক্রিয়াটিকে বজায় রেখেছে। অন্যদিকে আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা ও তার সাথে সম্পর্ক রেখে আমজনতার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদন কমে চলেছে দ্রুত। সুতরাং আম জনতার বিপর্যয়ের মুখে রাজনৈতিক দলগুলির কর্পোরেট প্রভুদের মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে নীতি নির্ধারণ করা ছাড়া জনগণকে কাছে টানার একমাত্র সম্বল হয়ে পড়ছে কর্পোরেট প্রভুদের দাক্ষিণ্যে পাওয়া অর্থবল। কর্পোরেট মুনাফার স্বার্থে কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্বের নামে যদি কিছু বিনিয়োগ হয়, তখন তারা আহ্লাদে আটখানা হয়ে জনগণের কাছে প্রচার করতে পারেন। অন্যথায় এই অর্থবলের সাথে সংকীর্ণ জাতি-সম্প্রদায়গত খেলায় মদত যোগানো ছাড়া তারা আর কোন পথ খুঁজে পান না এবং এভাবেই গণ-চাহিদার চাপকে তারা মোকাবিলা করেন। কারণ বিকল্প রাস্তাটি হচ্ছে উন্নয়ণের গণমুখী মডেল, ত্রিণমূল গণতন্ত্র ও পিরামিডাকৃতি ক্ষমতা-কাঠামোকে উল্টে দেওয়ার রাজনীতি এবং এই পথ অবলম্বন করা মানে নয়া-উদারবাদকে বিরোধিতা করা]

কিছুদিন আগে অরুণাচল প্রদেশে নির্মাণশিল্পে কর্মরত দিনমজুরদের উপর হামলা হয়। এই দিনমজুরেরা যে বাংলাদেশি মুসলমান নয় –- নিম্ন অসমের বাসিন্দা, সেটা প্রমাণিতও হয়। এবারও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের সূত্রপাত ঘটে উজান অসমে দিনমজুরদের হেনস্তার মধ্য দিয়ে। এই আক্রান্তরাও মূলত নিম্ন অসমের বাসিন্দা ও সড়ক নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ঠিকা শ্রমিক। এই আক্রমণের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারী ইস্যুকে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হয় আসু ও তার নতুন তৈরি মঞ্চ ‘নেরসু’। বাংলাভাষী মুসলমানরা তাদের মূল র্টাগেট হলেও বাঙালি হিন্দু, নেপালি, বিহারিরাও স্থানে স্থানে তাদের অক্রমণের লক্ষ্য হয়।

               অসমে ‘বিদেশি খেদার’ নামে সংখ্যালঘুদের আক্রমণের এক ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে মুসলমানদের গণহারে কোতল করারও ইতিহাস। এধরনের বড়মাপের মুসলিম গণহত্যার সর্বশেষ সংযোজন ১৯৮৩’র নেলির দাঙ্গা। সত্তরের দশকে অসমে যে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন ও তার উপর ভিত্তি করে সত্তরের শেষের দিকে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাকে ধ্বংস করে দিতেই শুরু হয় আসুর ‘বিদেশি খেদা’ আন্দোলন। ১৯৮৩-তে নির্বাচন ঘোষণা করে আসু আন্দোলনের প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়, নেলি ছিল সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উগ্রজাতিয়তাবাদী প্রতিহিংসার বর্বরতম রূপ। নির্বাচনের পর স্বাভাবিকভাবেই স্তিমিত হয়ে পড়া উগ্রজাতিয়তাবাদী শক্তিরা অসম চুক্তির মাধ্যমে চাঙ্গা হয়ে উঠে। কিন্তু দীর্ঘ অগপ শাসন ও আলফা সন্ত্রাস অসমের জনজাতীয়দের মূল অসমিয়া সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। আক্রান্ত হওয়ার ভীতিকে উপেক্ষা করে ন-অসমীয়ারা নিজেদের বাংলাভাষী পরিচিতেতে ফিরে যায়। উগ্রজাতিয়তাবাদী কার্যকলাপ অসমীয়া জাতির যে ক্ষতিসাধন করে তাতে উগ্রজাতিয়তাবাদীরা দ্রুত জনভিত্তি হারাতে শুরু করে। তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠার যে সম্ভাবনা দেখা দেয় তাকে প্রতিহত করতে নেওয়া হয় নতুন কৌশল। শুরু হয় জনজাতীয়দের ন্যায্য ক্ষোভকে সংকীর্ণতাবাদে রূপান্তরিত করে সন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করার মাধ্যমে। নিম্ন অসমে বড়ো সন্ত্রাসীদের জাতি-নির্মূলীকরণের (Ethnic Cleansing) অভিযান স্বীকৃতি পায় বিটিসি গঠনের মধ্য দিয়ে। এবার জনগোষ্ঠীগত হিংসা ও ঘৃণাকে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী ও জনজাতীয় সংকীর্ণতাবাদ এক মঞ্চে সামিল হয়েছে।

                 উজান অসমে আসুর সংখ্যালঘু বিরোধী অভিযানে কংগ্রেস সরকার প্রথম দিকে মদত দেয়। কংগ্রেসিরা নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘সাপ হয়ে কাটা ও ওঝা হয়ে ঝাড়ার’ – তাদের পুরোনো রণকৌশলটি প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হয়, যাতে সংখ্যালঘুদের ত্রাতা হিসেবে তাদের হারানো মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক ফিরে পাওয়া যায়। বিশ্বায়নের নীতির ফলে দুরবস্থার দ্রুত বৃদ্ধিজনিত ক্ষোভ থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতেও অনুপ্রবেশকারী ইস্যুটিকে চাঙ্গা করাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আসু-নেরসু ও সংঘ পরিবারের এবারের সংখ্যালঘু বিরোধী এই চালে রয়েছে বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের ছায়াও।

              রাশিয়ার জর্জিয়া আক্রমণ প্রমাণ করে দিয়েছে যে বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী রণনীতি রাশিয়ান অক্ষশক্তির চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জর্জিয়াকে আমেরিকার সামরিক সাহায্য, পোলাণ্ডে আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন, কাসপিয়ান অঞ্চল ও কৃষ্ণ সাগরে ক্রমবর্ধমান সামরিক গতিবিধি, কিউবাতে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে রাশিয়া-আমেরিকা সংঘাতের পারদ তড়তড় করে চড়ছিল। জর্জিয়াকে ন্যাটোভুক্তির আমেরিকান প্রচেষ্টা ও ৭-৮ আগস্ট আমেরিকার মদতে জর্জিয়ার সামরিক অভিযান ও দক্ষিণ ওসেটিয়ায় প্রায় ২০০০ সামরিক নাগরিককে হত্যার পর রাশিয়ার সেনাবাহিনী জর্জিয়ায় প্রবেশ করে। এই হত্যালীলার ভিডিও রেকর্ডিং এবং রাশিয়ান আক্রমণে সন্ত্রস্ত ও পলায়নরত জর্জিয়ান বাহিনীর মধ্য থেকে আমেরিকান ইংরেজিতে কথাবার্তার রেকর্ডিংও রয়েছে রাশিয়ার কাছে। ১৯ আগস্ট জর্জিয়া প্রশ্নে ন্যাটোর সভায় আমেরিকান আবেদঙ্কে অগ্রাহ্য করে বেশীরভাগ ইউরোপিয়ান দেশই রাশিয়াকে সমর্থন করেছে। দক্ষিণ ওসেটিয়া ও অবখাজিয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদানের পর রাশিয়ার মৃদু নিন্দা শোনা গেলেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধের আমেরিকান প্রস্তাবে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশগুলি সম্মতি দেয়নি। কারণ, একদিকে রাশিয়ার তেল সরবরাহের উপর ইউরোপীয় দেশগুলির নির্ভরশীলতা এবং অন্যদিকে আমেরিকান বিশ্ব আধিপত্যকে খর্ব করার সাথে তাদের স্বার্থও জড়িয়ে থাকা। রাশিয়া ইতিমধ্যে ন্যাটোর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে এবং সফলভাবে নতুন প্রযুক্তির ‘টপল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ পরীক্ষণ করে আমেরিকার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে আমেরিকার মিত্র হিসাবে পরিচিত তুরস্কও কৃষ্ণসাগরে সামরিক গতিবিধির জন্য তাদের বন্দর ব্যবহার করার আমেরিকান প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। চীন ও রাশিয়া সহ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ‘সাংঘাই কোঅপারেশন অর্গেনাইজেশন’ রাশিয়াকে সমর্থন করেছে, যদিও নিজেদের অভ্যন্তরিণ কারণে স্বাধিণতার স্বীকৃতির প্রশ্নে কোন মন্তব্য করা থেকে চীন বিরত থেকেছে। এস.সি.ও’র সভায় পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে ভারতীয় প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। ‘নিউক ডিল’-এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে না। তবে একথা খেয়াল রাখা জরুরি যে শীতল যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ‘সোভিয়েত রাশিয়ার’ সাথে যে সম্পর্ক ছিল, প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার সাথে সে সম্পর্ক এখনও অটুট রয়েছে এবং সম্প্রতি ব্রাহ্ম এরোস্পেস যৌথ উদ্যোগের জন্য ভারত রাশিয়ার কাছে ২ বিলিয়ল ডলার মূল্যের ক্ষেপণাস্ত্রের অর্ডারও দিয়েছে। জর্জিয়া আক্রমণকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের যে ছবি সামনে চলে এসেছে এধরনের সংঘাত আগামীদিনে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে থাকবে। রাশিয়ান অক্ষশক্তির প্রধান এশিয়ান অংশীদার হচ্ছে চীন। সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের এপিসেন্টার হচ্ছে মধ্য এশিয়া। সে হিসাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং তাই সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের শিবির বিভাজনের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকারের ‘পূর্বে তাকাও নীতি’ এবং চীন-ভারত ও আশিয়ান দেশগুলির বাণিজ্যিক-আর্থিক নৈকট্য স্থাপনের ক্ষেত্রে মায়ান্মার হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ করিডর। মায়ান্মার-বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডারের দিকেও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শ্যেনদৃষ্টি। মায়ান্মারের আর্থিক-সামরিক ক্ষেত্রে ও জুন্টা সরকারের উপর রয়েছে চীনের প্রভাব। চীন পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় দেশগুলির একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী তৈরি করতে এবং আতে জাপানকেও সামিল করে নিতে আগ্রহী। জাপানের সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সংঘাত, মালয়েশিয়া-মায়ান্মার সহ আশিয়ান দেশগুলির সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সাথে জড়িত বাণিজ্যিক স্বার্থ জাপানকেও চীনের পরিকল্পনার দিকে আকৃষ্ট করছে। বাণিজ্যিক স্বার্থের সম্পর্কগুলি একমুখীন নয় এবং তাতে নানাধরনের জটিলতা রয়েছে, তথাপি আমেরিকা যে ক্রমশই এশিয়ার এই অঞ্চলে কোণঠাসা হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি এবং চীন-ভারত সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্র পথের বিকল্প সড়ক ও রেল যোগাযোগ গড়ে উঠা এবং মায়ান্মার-ভারত ও মায়ান্মার-চীন গ্যাস পাইপলাইন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আমেরিকার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন-ভারত-আশিয়ান বা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পরিকাঠামো গড়ার ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও বাস্তব অগ্রগতি বিচার করে দেখা যাক। সম্প্রতি চীন-ভারত যে প্রাচীন বাণিজ্য পথ রয়েছে সেগুলি চালু করা হচ্ছে। সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য সিকিমের গ্যাংটক থেকে ৫৪ কিঃমিঃ দূরে নাথুলা-পাস খুলে দেওয়া হয়েছে। তিব্বতের ইয়াতুং শহর নাথুলা-পাস থেকে মাত্র ৫২ কিঃ মিঃ দূরে। ব্রিটিশ আমলে চীনের কিং-রাজত্বের সময়ে তিব্বত ও ভূটানের বাণিজ্য পথ হয়ে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে বক্সা দিয়ে বাংলাদেশের রংপুর, গুয়াহাটির সন্নিকটস্থ হাজো থেকে তিব্বত হয়ে চীনের সিচ্যুয়ান প্রদেশের রাজধানী চেংগদুরের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ ছিল। গুয়াহাটির কামাখ্যার সন্নিকটে ব্রহ্মপুত্র নদ বন্দরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল যা পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বাণিজ্য পথ নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে সেটি বিস্তৃত রয়েছে চীনের ঝেজিং, হিউয়ান, গুরহও এবং ইউনান থেকে মায়ান্মার পর্যন্ত। ইউনানের রাজধানী কানমিং থেকে মায়ান্মার সীমান্ত অঞ্চল মিইতিকিইনা পর্যন্ত রেলপথের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ২০০৫-এর এপ্রিলে মায়ান্মার সীমান্ত খুলে দিয়ে ইউনান-ভিয়েতনাম রেলপথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ইউনান-অরুণাচল প্রদেশ-অসম-মণিপুর-মায়ান্মার সড়ক পথ নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ইউনান থেকে মায়ান্মারের মিইতিকিইনা হয়ে অসমের লিডো এবং লিডো থেকে মণিপুর হয়ে মায়ান্মার হয়ে থাইল্যাণ্ড পর্যন্ত মায়ান্মার-ভারত-থাইল্যাণ্ড ত্রিস্তরীয় মহাসড়ক বা এশিয়ান হাইওয়ে এবং আন্তঃএশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মণিপুর মায়ান্মার সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রেল-সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠার সাথে সাথে দক্ষিণ চীন সমুদ্রে ও মায়ান্মারের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতির পরিকল্পনাও আমেরিকা ভাল চোখে দেখছে না। ভারতও মিজোরামের কালাদান নদীর মুখে মায়ান্মারের পুরোনো ব্রিটিশ বন্দরের আধুনিকীকরণের মাধ্যমে নদীপথে বাণিজ্যেরও পরিকল্পনা করছে। আমেরিকা জাপান ও তাইওয়ানের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করলেও, জাপানের সাথে বাণিজ্যিক স্বার্থের সংঘাত তীব্র হচ্ছে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আমেরিকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে চীন-ভারত ও আশিয়ান গোষ্ঠীর সাথে জাপানকে সামিল করার চীনের পরিকল্পনার দিকেই জাপান ঝুঁকে পড়বে। সুতরাং এই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে ভারতই হবে আমেরিকার কাছে দাবার ঘুঁটি। সেক্ষেত্রে উত্তর-পূর্বাঞ্চলও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়নের (DoNER) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন – “উত্তর-পূর্বাঞ্চল এখন আর স্পর্শকাতর অঞ্চল নয়, এই অঞ্চল শুধুমাত্র ভারতবর্ষের জন্য নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন, বাংলাদেশ, ভূটান মায়ানমারের জন্য একটি রণনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল”। বাণিজ্য মন্ত্রী কমল নাথ মন্তব্য করেন যে চীন-ভারতের সাথে আশিয়ানই এশিয়ার ভবিষ্যত। মায়ান্মারের উপর রয়েছে আমেরিকার অবরোধ (Sanction )। মায়ান্মার সরকারের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করতে আমেরিকা চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ভারত সরকার মায়ান্মারে বিনিয়োগ করতে এবং সে দেশের গ্যাস সরবরাহ পেতে আগ্রহী। মায়ান্মারের উপর রয়েছে চীনের প্রভাব। সেজন্য ভারত আমেরিকার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। মায়ান্মারের ভূগর্ভস্থ গ্যাসের ড্রিলিং-এর কাজের ৩০ শতাংশে ভারতের অংশীদারীত্ব রয়েছে এবং ভারতের ইঞ্জিনিয়ার কারিগররা ড্রিলিং-এর কাজের সহায়তা করছেন। ওনজিসি ও গ্যাস অথরিটি অব ইণ্ডিয়া মায়ান্মারের বৃহত্তর গ্যাস ফিল্ড ‘শিউফিল্ড’ ডেভেলাপমেন্টের কাজে যুক্ত রয়েছে। অপরদিকে চীনের তেল কোম্পানীর সাথে বিভিন্ন দেশে যৌথ উদ্যোগ ইস্পাত সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রসারিত হচ্ছে। চীন-ভারত বাণিজ্যের বৃদ্ধি ঘটছে এবং এক্ষেত্রে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। আশিয়ানের সাথে ভারতের বাণিজ্য ২০০৫-০৬ সাল থেকে ২০০৬-০৭ সালে আমদানীর ক্ষেত্রে ৬৬% ও রপ্তানীর ক্ষেত্রে ২০.৬৭% বৃদ্ধি ঘটেছে (Source : Director General of Commercial Intelligence and Statistics) আশিয়ানের সাথে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধির হার ৩০%। ভারতের বাণিজ্য চীনের সাথেই সবচাইতে বেশি। ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতির জন্য সিকিমকে ভারতের অঙ্গ বলে চীন সরকারীভাবে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে গ্যাস রিজার্ভকে কেন্দ্র করে আমেরিকান তৎপরতা এবং বাংলাদেশ সনুদ্রবন্দরে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য আমেরিকার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক আমেরিকান সান্রাজ্যবাদ বিরোধী গণচেতনার উন্মেষ ঘটেছে। এই গণচেতনার ভয়েই বাংলাদেশের তদারকি সরকার এমনকী টাটাদের সাথেও চুক্তি করা থেকেও বিরত থাকে এবং সম্প্রতি টাটারা বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে নতুন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলির বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ। চীন-ভারত-মায়ান্মার সবকটি দেশই অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অধিকার মেনে নিতে অস্বীকার করে। ১৭৮৪-তে আরাকান অঞ্চল অধিগ্রহণের পর এবং পরবর্তীতে জাপানী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের অধিগ্রহণ ও চক্রান্তের ফলে রহোঙ্গিয়া জনগোষ্ঠীর কোন অধিকার সাব্যস্ত হয়নি এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কক্সবাজারে এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর বহু লোক এখনও রিফিউজি এবং মায়ান্মারে তারা অনুপ্রবেশকারী সমস্যার শিকার। মায়ান্মার সরকার বিভিন্ন বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর সাথে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পুরো দেশে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করলেও রোহিঙ্গিয়া সহ বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে শান্তি চুক্তি এখনও হয়ে উঠেনি। মায়ান্মারের জুন্টা সরকারের কোনধরনের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানাই স্বাভাবিক, যদিও আশিয়ানভুক্ত দেশ হিসাবে তারা মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের চাকমাদের প্রশ্ন নিয়েও রয়েছে জটিলতা এবং চাকমারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যে বহিরাগত হিসাবে প্রায়শয়ই আক্রমণের শিকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মত চীনের ইউনান প্রদেশ বঞ্চিত ও অনুন্নত, তীব্বতীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি চীন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী ফ্যাসিস্টসুলভ।

এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগোষ্টীগত বঞ্চনার বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে উগ্রজাতিয়তাবাদী, জনজাতীয় সংকীর্ণতাবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং থাইল্যাণ্ডের অস্ত্রব্যবসায়ী কুখ্যাত স্বর্ণ ত্রিভুজের (Golden Triangle) সাথে সম্পর্ককে ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল সহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করার পেছনে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ জড়িত থাকাই স্বাভাবিক। তিব্বতীদের সংগ্রামে যে আমেরিকানরা গণ্ডগোল পাকাতে চাইছে এটাও স্পষ্ট। এবারের অনুপ্রবেশ ইস্যু নিয়ে ঘটনা পরম্পরাও এদিকেই ইঙ্গিত করছে। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাশিয়ান প্রতিনিধি দল অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে পরিকাঠামো ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিময়ের ব্যাপার আলোচনা করে। বাংলাদেশ আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে বলে একটা ধারণা তৈরি হচ্ছিল, এখন আবার উল্টো ইঙ্গিত আসতে শুরু করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার জন্য চীন-ভারতকেই দায়ী করছে ওয়াশিংটন এবং অন্যদিকে আশিয়ানের সাথে ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং এ’বছরের মধ্যেই চীন ও জাপানের সাথেও আশিয়ানের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। অন্যদিকে আমেরিকার শর্ত মেনে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করছে আশিয়ানভুক্ত মালয়েশিয়ার মত দেশও। সুতরাং চীন-ভারত ও আশিয়ান দেশগুলির বাণিজ্যিক উদ্যোগ ও আঞ্চলিক জোট গড়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য এঅঞ্চলে অস্থিরতা ও নাশকতা সৃষ্টির পেছনে আমেরিকান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা তৎপর থাকবে। এবং তাই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের মুখ্য কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করতে হলে এক বৃহৎ গণতান্ত্রিক জোট গড়ে তুলতে হবে। একটি গনতান্ত্রিক কর্মসূচীর ভিত্তিতেই এই জোট গড়ে উঠতে পারে, যে কর্মসূচীতে থাকবে বিদেশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রশ্ন, প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার – সমান মর্যাদার প্রশ্ন ও সম্প্রসারণবাদ, উগ্রজাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা। গণআন্দোলন ও গণপ্রতিরোধই দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের টুঁটি চেপে ধরবে।  

ডার্করুমে আজাদ

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

(হঠাৎ মনে উদয় হল – তাই এই অনুগল্পটি লিখে ফেললাম)
            তখন কত আর বয়স হবে তার। বছর দেড়েক হল ম্যাট্রিক পাশ করেছে। অসমীয়া মাধ্যমে পড়েছে সে, বাড়িতে বাংলা বললেও নিজেকে অসমীয়া-মুসলিম বলেই জানে বরপেটার ভানুবিলের আজাদ। নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির ছেলে। সেবার যখন সন্ত্রাসী আক্রমণে তার গ্রাম জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়, গ্রামের অন্য সমবয়সীদের সাথে সে প্রতিরোধে সামিল হতে পারেনি। তার সমবয়সীরা তাকে কাপুরুষ-মেয়েলি স্বভাবের বলে অবজ্ঞা করত। সেবার তারা সপরিবারে আশ্রয় নেয় রিফিউজি ক্যাম্পে। তাকেও রোজগারের সন্ধানে নেমে পড়েতে হয়। ভাল রোজগারের সন্ধান পেয়ে দুই বন্ধু পাড়ি দেয় মুম্বাই শহরে। উপেন বড়ো তার স্কুলের সহপাঠী এবং দুজনে গলায় গলায় ভাব।
          মুম্বাইয়ে এক ডিজাইনার কোম্পানীর ওয়ার্কশপের ডার্করুমে দুজনে একসাথে কাজ করে। কিন্তু অর্থ রোজগারের যে আশায় দুই বন্ধু মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিল তা এখনও পূরণ হয়নি – এই চাকরিতে নিজের খাওয়া-দাওয়ার খরচ শেষে বিশেষ সঞ্চয় করা যায় না। তাই অন্য ভাল কাজের সন্ধানে রয়েছে তারা।
যে মেসে তারা থাকে সেখানে টিভি দেখার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বাড়ি-মালিক। সেদিন রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে টিভির পর্দায় দুজনে চোখ রাখে। গুরদোয়ারায় আমেরিকান যুবকের সশস্ত্র আক্রমণের খবর উপেন খুব মনযোগ দিয়ে শুনে, কিন্তু আজাদ এই খবর শুনতে চায় না। তার গ্রাম আক্রমণের দুঃস্বপ্ন সে ভুলে থাকতে চায়।
           পরদিন যথারীতি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজনেই। দারোয়ান এসে খবর দেয় আজাদের একটা ফোন এসেছে। ফোন ধরতে চলে যায় আজাদ। কিছুক্ষণ পর আজাদ ফিরে আসে। অন্ধকারে উপেন তার শক্ত চোয়াল ও উদভ্রান্ত চেহারা দেখতে পায়নি। উপেন ফোনের খবর জানতে চাইলে, টেবিলে রাখা ছুরি তুলে নিয়ে সজোরে উপেনের বুকে বসিয়ে দেয় আজাদ উপেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আজাদও দেখতে পায়নি তার প্রিয় বন্ধুর প্রাণহীন মুখ। আজাদ রক্তরাঙা ছুরি উঁচিয়ে ধরে ডার্করুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ভাবলেশহীন আজাদকে এভাবে দেখতে পেয়ে আশপাশের সবাই তাকে ধরে ফেলে, কিন্তু সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না – শারীরিক যন্ত্রণার গোঙানির সাথে মিশে ‘আমি কাপুরুষ নই’ কথাটি তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে। পুলিশ এসে আজাদকে নিয়ে যায়। কথাবার্তা বলে পুলিশের মনে হয় সে মানসিক রোগী – চিকিৎসার জন্য তাকে আদালতের সুপারিশে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ খবর নিয়ে জানতে পারে সেদিন আজাদের এক আত্মীয় তাকে রিফিউজি ক্যাম্প আক্রমণের খবর দিয়েছিল, যে আক্রমণে অনেকের সাথে তার পরিবারের সবাই নিহত হয়।
         কিছুদিন চিকিৎসার পর তার মানসিক ভারসাম্য ফিরে এলে তাকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। আদালত থেকে জেলে পৌঁছতে পৌঁছতে মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে যায়। জেল আঙিনার একপ্রান্তে মুসলিম কয়েদিরা সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছে। আজাদও তাদের সাথে যোগ দেয়। জীবনে এই প্রথমবারের মত নামাজের মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে আজাদ।

প্রযুক্তি-চর্চা, সমস্যা জর্জরিত বরাক উপত্যকা ও বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , , ,

         

        (বেশ কিছুদিন আগে 'দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গে' এই লেখকের একটি চিঠি বেরিয়েছিল – সেই চিঠির বিষয়বস্তুকে নিয়েই 'অরুণোদয়' কাগজের  জন্য এই পুনর্লিখন – অরূপা মহাজন।)
           ঙ্গল গ্রহে ইসরোর উপগ্রহ অভিযানের জন্য ভারত সরকারের কেবিনেট ৪৫০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে। এই উপগ্রহটি নাকি লাল-গ্রহের বায়ুমণ্ডল যাচাই করবে। অর্থমূল্যের হিসেবে বিচার করলে এই অভিযানকে ভারতের মত দরিদ্র দেশের অর্থের অপচয় হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কিন্তু এই অভিযানকে ফলাও করে প্রচার করার মধ্যে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের দিশাহীন কিংবা একদেশদর্শী পরিকল্পনার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই অভিযানকে কেন এতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? তার দুটি মুখ্য কারণ রয়েছে। প্রথমত এতে আমাদের এলিট শ্রেণির এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষিত ও প্রভাবান্বিত মধ্যশ্রেণির সুপার-পাওয়ার হওয়ার সুপ্ত অলীক বাসনাকে আরেকটু উস্কে দেওয়া যায় – বিশ্ব এলিট ক্লাবের সাথে  গা-ঘেঁষাঘেষি করে তাদের ‘অল্টার-ইগোকে’ ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেওয়া যায়। সুপার-পাওয়ার হওয়ার এই বহিরঙ্গের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত একটা অন্তরঙ্গও রয়েছে যা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের এমনকি মানব সভ্যতার জন্য বিপদজনক। কী সেই বিপদ? বহিরঙ্গে সুপার-পাওয়ার হওয়ার প্রয়াস অন্তরঙ্গে সুপার হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেই করতে হয় অর্থাৎ আমাদের এলিট শ্রেণি ও তাদের পোঁ-ধরারা যখন ইউরোপ-আমেরিকার সমকক্ষ সঙ্গী হওয়ার চেষ্টায় ব্রতী, তখন কোটি কোটি নিরন্ন দরিদ্র মানুষ যারা খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি করার ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে এলিট-শ্রেণির উপরে উঠার প্রক্রিয়ায় অন্তরায় হতে চায় – তখন এই নিরন্ন-হাঘরেদের পদদলিত করেই তাদের বাসনাকে কায়েম করা যায় এবং এরজন্যই উন্নত প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করা হচ্ছে – তা সে নিউক্লিয়ার এনার্জির জন্যই হোক বা বিগড্যাম। প্রযুক্তির এই চর্চার সাথে সৃজনশীলতার বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই –এটা একধরণের স্কিলের চর্চা। অথচ আমজনতার সমস্যা সমাধানের সাথে যদি প্রযুক্তি চর্চার বিষয়কে জুড়ে দেওয়া যেত তাহলে প্রযুক্তিচর্চার সাথে যুক্ত সবাই সৃজনশীল গবেষণার এক বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে সামিল হয়ে দেশ গঠনে ব্রতী হওয়ার সুযোগ পেত। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে যাতে বৌদ্ধিক সমাজ প্রভাবিত না হয় – সেটাই               মঙ্গল-অভিযানকে ফলাও করে প্রচার করার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্নিহিত কারণ। অথচ আধুনিক ইউরোপ যে এই পথ পরিক্রমা করেই এসেছে সে ব্যাপারে আমাদের এলিটরা অবগত হলেও ন্যস্তস্বার্থে ও ওলিগোপলিস্টদের (একচেটিয়া কর্পোরেটদের গ্রুপ) সেবাদাসত্বের দাসখতে সই করে জ্ঞানচর্চার এক ভ্রান্ত পথের দিকে দেশ-জাতিকে পরিচালিত করছেন।  উন্নত প্রযুক্তির ঢোল বাজিয়ে কর্পোরেট প্রভুদের নির্দেশে ২০০৫ সালে বিদ্যুৎ ক্ষেত্র সংস্কারের আইন পাশ করা হল। দীর্ঘ সাত বছর পর উন্নত প্রযুক্তির দেশজোড়া নমুনা দেখল দেশবাসী। বিদ্যুত ঘাটতিজনিত যন্ত্রণার স্থানিক অনুভূতিকে দীর্ঘ তথাকথিত উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ মৃত-পুঁজির সৃষ্টি করে এবং সাধারণ মানুষের উপর বিশাল বিদেশি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে জাতীয় অনুভূতিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বিশ্বায়িত প্রযুক্তির বাজারে অনুভূতির বিশ্বায়নের দিকে যাত্রা। বিশ্বায়নের এই যাত্রার বিপরীতে একটা স্থানিক যাত্রার হিসাব আমরা এবার করে দেখতে পারি। কারণ যখন প্রযুক্তি শিক্ষার নামে মঙ্গল গ্রহে যান পাঠাচ্ছে আমাদের সরকার, তখন বরাকের মানুষরা নিজের অঞ্চলের বাইরে বেরোতে নিজের প্রাণটাকেই অজানা ভিন-গ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
                 বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় আমাদের এঅঞ্চলে কৃতবিদ্যদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু কৃষি-শিল্প-নাগরিক সুযোগ সুবিধা-পরিবেশ ইত্যাদি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকল্পে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও তার বাস্তবায়ন আমাদের খুব একটা চোখে পড়ে না। ভাষা-সংস্কৃতি-উৎপাদন পদ্ধতি-জলবায়ু ইত্যাদি সবদিক থেকে আমাদের মত বৈচিত্রময় দেশে যে কোন সমস্যার একটা স্থানিক মাত্রা থাকে। কিন্তু বাস্তব পৃষ্ঠভূমি থেকে সমস্যা সমাধানের বাস্তব কোন পদ্ধতি আবিষ্কারের কষ্টসাধ্য ও সৃজনশীল পথ পরিহার করে আমরা অনুকরণের মাধ্যমে দক্ষ বিশেষজ্ঞ তকমা পেতে বেশি আগ্রহী। জ্ঞানার্জনকে বাজারের চাহিদার দ্বারা পরিচালিত দক্ষতার (Skill) স্তরে নামিয়ে আনার পরও আমাদের সমাজ নামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথে দেখে, কারণ সমাজ ধরে নেয় যে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান এতো বিশাল যে তার থেকে সমাজ উপকৃত হবে। কিন্তু বাস্তবে এই  দক্ষ লোকদের সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও সামাজিক অবনতির মাত্রা কেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে? এর উত্তর আমাদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সাথে সাথে সম্ভবত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও নিহিত রয়েছে। সম্প্রতি এক টিভি-চ্যানেলের বিতর্ক প্রোগ্রামে একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ চিকিৎসক মন্তব্য করেন যে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি ক্রমাগত অনুভূমিক (Horizontal) থেকে উলম্ব (Vertical) হয়ে যাচ্ছে এবং ফলে সামগ্রিক জ্ঞানের মাধ্যমে সৃজনীক্ষমতা বিকাশের বদলে এটা একধরনের ট্রেনিং-এ রূপান্তরিত হচ্ছে – সবকিছুই এখন উন্নত  থেকে উন্নততর ওয়ার্কশপ যেখানে পুঁজির সেবা করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক তৈরি করা হচ্ছে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিকাশের বদলে শিক্ষার মানে হয়ে যাচ্ছে পুনঃপুনঃ পাঠের মাধ্যমে একধরনের মুখস্ত বিদ্যা (Learning by rote)। এরমধ্যেই ব্যতিক্রমী কাজ যে হচ্ছে না তা নয় –  কিন্তু তা সাধারণত মিডিয়াকে, বাজারের নিয়মকে ও নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করতে পারে না। এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না – কারণ গোটা সমাজ গুটি গুটি পায়ে অতি সত্বর এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে পা বাড়াচ্ছে। যদি আমরা মনে করি যে সব বিজ্ঞানই শেষ বিচারে মানব সভ্যতার জন্যই, যে সভ্যতা আজ অস্তিত্ব সংকটের    সামনে দাঁড়িয়ে গেছে – তাহলে আমাদেরকে বিকল্প পথ অনুসন্ধান করতেই হবে।
               অত্যন্ত ছোট মাপের কাজের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। সারা পৃথিবী জল সংকটে ভুগছে – জল নিয়ে প্রায় যুদ্ধ বাধার উপক্রম। দক্ষিন ভারতের কোন এক শহরের পুরসভা ছাদের জল সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়ে উপকৃত হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে যখন জল সংকট, তখন থর মরুভূমির এক বসতি অঞ্চল কোন ব্যয়বহুল পদ্ধতি অবলম্বন না করেই জল সমস্যার সমাধান করে নিয়েছে। আমাদের শিলচরের কোন বিশেষজ্ঞ ছাদের জল নিয়ে একটা হিসাব করতেই পারেন এবং তাতে যদি দেখা যায় আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহলে পুরসভা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তা বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে। জল নিষ্কাশনী সমস্যার  সমাধানেও কোন উদ্ভাবনী প্রয়াস নজরে পড়ে না – জল নিষ্কাশন ও জল সংরক্ষণকে সম্পৃক্ত করে ভাবলে কোন সমাধানসূত্র বেরতেও পারে। বরাকের কৃষির অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং তারজন্য বিভিন্ন ফ্যাক্টর দায়ি। কিন্তু বরাকের কৃষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সার-সংকলিত করে কোন বিকল্প পন্থা-পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা কেউ করছেন বলে শোনা যায়নি। মাত্র ১০০/১১০ মেগাওয়াট চাহিদা থাকা একটা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন এক বৃহৎ কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সামাজিকভাবে উপযোগী-স্থায়ী ও সস্তায় এই নগণ্য পরিমাণ  বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যোগানের বন্দোবস্ত এখানেই করা যায় বলে আমাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের এঅঞ্চলের কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কাজ করছে কি? মনে হয় – না। অথচ প্রতিবারই সমস্যা সমাধানের নতুন নতুন মন্ত্র আমাদের শোনানো হয় – এবারের নতুন মন্ত্র হচ্ছে পালাটনা, ভাবখানা এরকম যে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বরাকের চাহিদা মেটানোর জন্যই তৈরি হচ্ছে, আর বরাক ড্যাম – সে তো আরেক মিথ্যার বেসাতি।  সব পরিকল্পনা তৈরি করা হয় বিদেশি ঋণ ও প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে, তাতে সম্পদের বহির্গমণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটে প্রকৃত অর্থনীতি পঙ্গু হলেও নীতি নির্ধারকদের কোন মাথাব্যথা নেই। 
              এখন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হচ্ছে। ব্যয়বহুল সব পদ্ধতির কথা আমাদেরকে শোনানো হচ্ছে যা আমাদের মত দেশে বাস্তবে গণহারে কার্যকরী হওয়া সম্ভব নয়। ভূমিকম্প রোধ ও ভূমিকম্প থেকে বাঁচানোর কার্যকরী কোন পদ্ধতি যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে এই ব্যয়বহুল মচ্ছবের কী অর্থ? সব বিষয়ের উপর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে ওয়ার্কশপ হয়। ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত কার্যকরী ও সৃজনশীল আবিষ্কারের ট্যাকনিক্যাল তথ্য এই ওয়ার্কশপগুলোতে দেওয়া হয়। প্রথমত এই বিষয়গুলি ট্রেনিরা ট্রেনিং-লিটার্যা চার থেকে নিজেরাই আয়ত্ব করে নিতে পারে, দ্বিতীয়ত আমাদের বাস্তব পরিস্থিতিতে এগুলোর বিশেষ কোন বাস্তব কার্যকারিতা নেই। সুতরাং এই ওয়ার্কশপগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বোঝাগুলো মাথায় বয়ে নিয়ে বেড়ানো কি অর্থহীন হয়ে পড়ে না?

Final draft memorandum on recent turmoil, politics of ethnic cleansing and BTC

Posted by স্বাভিমান



ASOM MOJURI SRAMEEK UNION    
H.O. C/o N. k. Das, Khudiram Sarani, Sibbari Road, Tarapur, Silchar - 788008
Regd No. 2287
Ref :  NIL                                                                                                                    Date : ২৮-০৭-২০১২
To,
The Honourable Chief Minister
Government of Assam
Dispur, Guwahati
(Through Deputy Commissioner, Cachar)

Sub – Memorandum

Respected Sir,
We, on behalf of various organizations would like to draw your kind attention to the fact that the recent orgy of violence that took away many innocent lives and torched innumerable Muslim villages speaks volumes about the politics of ethnic cleansing prevailing in the BTAD area. The mayhem let loose by the armed Bodo militant groups supported by biased political administration of BTC and an insensitive civil and police administration has compelled the lakhs of Muslim villagers to flee and take refuge in the camps to live the inhuman life of their predecessors who are still languishing in the makeshift camps as the victims of earlier similar genocide. In  front of an all out aggressive armed terrorist attack, the brave front of mass-resistance of the victims proved to be feeble and collapsing when the perpetrators of violence with their hegemonic position started an well orchestrated campaign of outside involvement with an intention to give an Islamic dimension of Bangladeshi infiltration to justify the entire anti-Muslim operation. As the mistrust between the communities looms large in a terror-stricken environment, a section of poor Bodo masses also fled their villages and took refuge in the camps. A section of the Bodo leadership having a least sympathy to their poor community-brethren is deliberately amplifying it to emphasise the theory of outside involvement.   
We uphold the principle of equal rights and equal dignity of all the communities and this principle necessitates empowerment of all communities whose identity rights are at stake. But the way a section of Bodo leadership is spearheading the Bodoland movement to establish absolute hegemony and minority rule over all other communities who constitute the majority population in the BTC area is not in any way serving the interest of common Bodo masses. According to one estimate, Bodos constitute not more than 25 per cent of the total population in the BTC area (and not more than 6 percent of total population of Assam). This means that the BTC Accord gives the Bodos a special status under the Sixth Schedule of the Constitution at the cost of 75 per cent of non-Bodo population in the proposed BTC area. 
This movement with an undemocratic essence has naturally transformed itself into a chauvinist-terrorist onslaught through complete lumpenisation of the polity and twisting mass-psyche of disrespect towards the democratic rights of others. The armed Bodo organizations are bent on instilling a fear psychosis in the minds of all non-Bodo population with tacit support of their patron at the helm of affairs.

                                                                                                                                  Contd. To Page 2

(2)
This type of pogrom against the non-Bodos is not new and unfamiliar in this BTAD area. Actually the history of the movement for Bodoland and divide Assam fifty-fifty launched in the name of the assertion of Bodo identity rights is mired with killings of thousands and large-scale eviction of lakhs of people especially Santals and Muslims. A horrific attack in Muslim villages including the refugee camp in Barpeta District in 1994 and similar attack on Santals in 1996 are still fresh in the minds of the survivors and the victim families. In 2008, a rumour of a missing Bodo youth gave the alibi to the Bodo Terrorists to let loose a reign of terror on the Muslim populace in Darang and Udalguri districts  killing 55, injuring more than 100 and pushing more than 1.5 lakhs of muslim masses to refugee camp by completely shattering 54 villages according to one estimate. The death and destruction during the attack on Santals in 1996 had even surpassed this horrific scale. All other communities including the Bengali Hindus are muted through terror tactics and they have to live in a state of terror and submission.
This overt way of annihilation, covert way of leading those in the camps to die slowly in an inhuman living condition and forced displacement through eviction are machinated to establish the Majority figure of the Bodos who are otherwise minority in the entire landscape of Bodoland demanded. To put the figure straight, the Bodos in the area constitute less than 20 per cent of the population, but have been deemed fit to command an unassailable, absolute majority in the proposed Council. Over 65 per cent of the seats in the Council are reserved for Scheduled Tribes (STs), whereas the total ST population, including the Bodos, is around 30 per cent.  It is Bodoland for the Bodos even when the territory has only an absolute minority of Bodos. This is a gross violation of equality and democratic rights. Given the savage violence with which ethnic cleansing by the armed Bodos has been taking place in the area for decades, handing over considerable powers to the perpetrators of that protracted violence has meant the end of all guarantees of safety, livelihood and democratic rights for the non-Bodo majority. The sixth schedule has even deprived the non-Bodos from the powers that have been enjoyed by the people in the rest of Assam through Assam Panchayat act promulgated on the basis of 73rd constitutional act.
But the three men expert commission set up by the centre to propose solution of this vexed problem do not subscribe to the formation of BTC. This commission consisted of the Chairman, Bhupinder Singh, a long-time handler of tribal affairs for the Union Home Ministry; Kumar Suresh Singh an anthropologist and administrator; and, a member secretary supplied from the Home Ministry’s ranks. This commission was to look at both the Bodo and the Mising questions on the north bank of the Brahmaputra. We would like to summarise very briefly its recommendations so far as they pertain to the Bodo question.
The commission had access to the linguistic tables of the 1991 census. From their study of it, they concluded that the Bodos had majorities at the village and village cluster levels only. This was a crucial finding. Keeping in mind the aspirations of the Bodos, the commission proposed two things, one for the state level and another for the regional level. At the regional level, it proposed a three-tier structure of self-government, two of them territorial, at the village and village cluster levels, and a coordinating body above the two. All three bodies were to have demarcated but interpenetrating powers. At the state level, the commission proposed a second chamber for the legislature, a sort of house of ethnicities, with definite powers, including the veto over the lower chamber in certain matters, to ensure self-rule and the cultural and social autonomy of the various ethnicities. The question of the Sixth Schedule could not possibly occur in such a proposal. That or any large-scale territorial autonomy had become untenable on account of the demographic findings.                                                                                                                       Contd. To Page 3
(3)
                                                                            
But the objectives as stated in  the agreement are: to create an Autonomous self governing body to be known as Bodoland Territorial Council (BTC) within the State of Assam and to provide constitutional protection under Sixth Schedule to the said Autonomous Body;                                              to fulfil economic, educational and linguistic aspirations and the preservation of land-rights, socio-cultural and ethnic identity of the Bodos; and speed up the infrastructure development in BTC area. So the formation of BTC itself curtailed the rights of non-Bodos who are majority in the area demarcated.
Under the circumstances stated above, we put forward the following demands for your perusal and immediate needful action.
(1)   All the arms of the Bodo militant organizations who are under ceasefire must be seized immediately.
(2)   All the past evicted people who are languishing in the makeshift camps and the evicted people of recent violence must be suitably rehabilitated and compensated,
(3)   BTC must be dissolved and BTAD must be abrogated immediately.
(4)   The present BTAD area vis-à-vis entire state of Assam must be re-structured on federal basis to ensure equal-rights and equal-dignity of all the communities of Assam including the Bodos.  
                                                                                                              Yours faithfully



















Copy to – (1) Hounourable Governor, GoA, Dispur. (2) Honourable Prime Minister, GoI, New Delhi (3) Honourable Home Minister, GoI, New Delhi. (2) The Chairperson, National Human Rights Commission, GoI, New Delhi.

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator