Posted by স্বাভিমান

A Dream that comes true

Part -1

I had a dream that began when I fell asleep last night. The dream lasted for many hours, and since I often wake up late, it continued even in the bright daylight. In the dream, I visited the site of Karl Marx's grave. To my astonishment, Marx awakened from his slumber beneath the grave and appeared before me. He seemed to understand my confusion and surprise, leaving me spellbound by this unexpected encounter. Gradually, the atmosphere became more normal as he initiated a conversation with me. I asked my first question, and this led to a long and engaging interaction between us. The conversation unfolded as follows.

Me: What relevance do you have in today's world? In your time, you explored society to uncover social laws of motion, but nothing has really materialised until now.

Marx: You identify as a Marxist in this present world. That is my relevance.

Me: But some people claim that Marxism is merely a doctrine, a faith. Every faith in each era has its own followers. Does that mean I am a doctrinaire? I'm not so sure.

Marx: What exactly makes you doubt? If you are a doctrinaire, how can you also doubt your doctrine? Can doubt and doctrine coexist?

Me: You emphasised that objective reality shapes subjective reality. Your successful follower, Lenin, highlighted vanguardism and the importance of subjective effort. However, both of you acknowledged the two-way interaction between the two. Does this recognition negate the determinism present in both views?

Marx: We both stressed the interdependence of the subject and the object. It’s a matter of emphasis based on the specific context. So why do you perceive determinism?

Me: You recognised the two sides of reality: human labour and nature. Both aspects, when combined, constitute our reality. You then identify that human labour changes nature, and this altered nature impacts the relationship. You term this phenomenon "metabolic drift." This metabolic drift is a continuous process intertwined with the flow of time. Your concept emphasises the importance of time in this context, with neither a clear beginning nor an end. However, you introduced the idea that a radical change in social relations of production could bring about an end. You proposed the concept of conscious effort, which directs changes towards a desired outcome. This brings us to your philosophy, known as the philosophy of praxis. What does this practice entail? You explored this concept within a capitalist society while attempting to uncover the laws of social change. However, your successful disciple, Mao, applied this concept in a more backward society. Through real-world practice, we learn about and transform the world. He summarised this idea with the phrase "From the Masses to the Masses."

Marx: Why are you confused then? My disciple did a new experiment.

Me: Exactly. There lies my confusion. Is Marxism an experimental science? The innovation marked classical Europe. The infrastructural construction spree marked the Italian Renaissance period. A vast body of literature based on binary logic has emerged. The protagonist, Dr Faust, epitomised the binary in the Renaissance play, the good versus the evil, and religion versus secularism. The self is always fashioned. Renaissance men are never born fully formed as self–renaissance people start to fashion their identity through conspicuous consumption. Exuberant multiculturalism and bravura consumerism. Wilhelm Meister’s Apprenticeship illustrates the conflict between the end of the classical Renaissance period, characterised by innovation and infrastructure development, and the beginning of the Industrial Revolution during the Enlightenment. Did you, Mr Marx, give us a law of social motion that resolves the contradictions of industrial European society to transcend it?  Is this the reason why you claim that you are a post-classical and post-enlightenment radical theoretician? However, I am still confused about how your philosophy of praxis fits into this narrative.

Now we stand face to face. I am a Marxist, but I remain confused, and you are Marx himself. We do not form any binary despite standing a distance apart due to the confused and uncertain state that needs to be resolved. In nature and society, you find all categories in binary opposition, which critics define as dualism.  Is it true, Mr Marx?  Like other Marxists, I refute the charge as your principal law is “unity of opposites”. This Hegelian concept confuses me because I immediately think of a magnet with a north and south pole. We can easily measure and map its influences using a simple tool like a compass. But what is happening in society, Mr Marx?  Are we, the Marxists, not in a measurement crisis? What is actually the subject–object relationship? The answer should come from you to save Marxism and for radical social change.   

Posted by স্বাভিমান

 

*উচ্ছেদের অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং রাজনীতির উচ্ছেদ*

 

আসামে যে সময়ে উচ্ছেদ অভিযান জোর পেয়েছে, সেই সময় বিশ্বব্যাপী নিওলিবারেল ফিনান্সিয়্যালিজম পরিত্যাগ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।   পুঁজিবাদের অতি-উৎপাদনের (over-production) সংকট, কিংবা বেকারত্ব বৃদ্ধি ও মজুরি পড়ে গিয়ে ঊনভোগের (Under-consumption) সংকট থেকে বেরিয়ে আসার প্রাথমিক স্বপ্ন ও স্বপ্নের হ্যাংঅভারের পর্যায় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। বিশ্ব ক্ষমতাকেন্দ্রের অভ্যন্তরিণ দুর্বলতা এমনভবে প্রকট হয়েছে যে সবাই একে অপরকে কনুই-ঠেলে নিজের মরদেহের সাড়ে তিন হাত জায়গার মালিকানা নিয়ে নিতে চাইছে।

উদারবাদ থেকে বেরিয়ে আসার মরিয়া চেষ্টা নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। ২০১৯ সালে চিন থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার আমদানির উপর ট্রাম্প ১০% ইম্পোর্ট টারিফ লাগিয়েছিলেন। চিন তার মূদ্রা রেনমিনবি ডলারের তূলনায় অনেক নিচে পড়তে দিয়ে ওয়ার্লড স্টক ও সরকারি বণ্ডের বাজারে পড়তি আয়ের হাহাকার লাগিয়ে দেয়। এবারও ট্রাম্পের টারিফ কার্ড আশানুরূপ ফল দেয়নি। লেবার আর্বিট্রেজের নিওলিবারেল পুনর্গঠন অর্থাৎ সস্তা শ্রমের দেশে ফ্যাক্টরি নিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে আমেরিকাতে ম্যানুফেকচারিং বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। 

তবে বাণিজ্য পথে সামরিক দাপট ও বিশ্ব রপ্তানী বাণিজ্যে আমেরিকান বাজারের টানে ডলার নির্ভরতায় আমেরিকান বিশ্ব-দাপট এখনও বজায় থাকলেও, অভ্যন্তরিণ বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদার পতন ওয়ালস্ট্রিট ও মেইনস্ট্রিটের সংঘাতকে তীব্র করেছে, ডলার বহির্ভূত আঞ্চলিক মূদ্রায় বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং চিনের সামরিক শক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে রেইনমিনবির উপর নির্ভরতা বাড়ছে। 

অন্যদিকে চিনের বিদেশি বিনিয়োগ মূলত পরিকাঠামোয়, বাণিজ্য পথ নির্মাণে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর উৎপাদনে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকায় সোলার সেল উৎপাদন অত্যন্ত শোষণমূলক। শোষণমূলক বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মূল্যের চলাচলের একটি হিসাবে দেখা গেছে যে, বিশ্বশক্তি হিসাবে চিনের অবস্থান এখন উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের মাঝামাঝি থেকে অনেকটা উপরে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বশক্তি হিসাবে চিনের অগ্রগতি অনেকটাই নির্ভরশীল বহির্দেশীয় বিনিয়োগ থেকে অতিরিক্ত মূল্য আহরণ করে অভ্যন্তরিণ বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির উপর। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা থাকা এক বিশাল মধ্যবিত্তের চাহিদার বাজার সৃষ্টি, আর তার পরিণতিতে দেখা দেওয়া তীব্র অসাম্যের ভার পরনির্ভরশীল দেশের শ্রমজীবীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। চিনের একদলীয় শাসনের জন্য একাজটি করা সহজ। আর প্রতিযোগিতা ও অরগ্যানিক কম্পোজিশন অব ক্যাপিটেলের নিয়ম অনুযায়ী পুঁজির ভৌগোলিক সম্প্রসারণের মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে মেনে নিলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাম্রাজ্যবাদী অগ্রগতিই ভবিতব্য। কিন্তু নয়া-উপনিবেশগুলিতে বিদ্রোহ এবং বিশাল মধ্যবিত্তের চাহিদার বাজার তৈরির প্রচেষ্টায় ভয়ানক পরিবেশ বিপর্যয় -- বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকটকে আরও গভীর করবে। 

দেশে দেশে সস্তাশ্রমের ভিত্তিতে নয়াউদারবাদী উৎপাদনী পুনর্গঠনের মাধ্যমে উন্নয়শীল দেশে যে বিনিয়োগ ও ঋণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল তার প্রধান অনুসঙ্গ ছিল "বিস্থাপনের মাধ্যমে সঞ্চয়ন"। অর্থাৎ একইসাথে সস্তা প্রাকৃতিক সম্পদ ও সস্তাশ্রমের যোগান সুনিশ্চিত করা  -- উচ্ছেদ জমি থেকে, উচ্ছেদ সম্পত্তি থেকে, উচ্ছেদ স্থায়ী কর্মসংস্থান থেকে এবং তার অনুসঙ্গ হিসাবে উচ্ছেদ লোকায়ত ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস থেকে। সেটা ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশে এনসার্কেলম্যান্ট মুভমেন্ট থেকে এই কারণে গুণগতভাবে আলাদা যে, সেসময় অতিরিক্ত শ্রমের উৎপাদনী পুনর্বাসন ও আমেরিকায় সম্প্রসারণের সুযোগ ছিল।  কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকটের দীর্ঘকালীন টিঁকে থাকা ও গভীর হওয়ার ফলে বিনিয়োগকারী উন্নত দেশ এবার নিজ দেশে ম্যানুফেকচারিং বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে গুরুত্ত্ব দিচ্ছে। বিশ্ব ফিনান্সিয়েলাইজেশনে চিনের গভীর সংযুক্তি সত্ত্বেও, চিনের একদলীয় শাসন ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ফলে দ্রুত অভ্যন্তরিণ ম্যানুফেকচারিং বিনিয়োগের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার সুবিধা রয়েছে। ফলে চিন বিনিয়োগের বাজারে দাপট দেখাচ্ছে। সে যা'ই হোক, অসমের উচ্ছেদ নিয়ে আলোচনায় প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিত হিসাবে বিশ্ব-ব্যবস্থার সামান্য উল্লেখ প্রয়োজন ছিল। 

কিন্তু যদি বিশ্ব-পুঁজিবাদী সংকট থেকে বেরিয়ে আসা না যায়, তাহলে দমনমূলক নীতি দিয়ে তো আর একটি ব্যবস্থা টিঁকিয়ে রাখা যায় না -- সার্বিক ধ্বংস বা সমাজবাদী উত্থান নিশ্চিত। বিশ্ব-পুঁজিবাদ যখন নতুন পথের সন্ধানে বিভিন্ন ধরনের প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিতর্ক করছে, তখনই মধ্যভারতে মাওয়িস্ট দমনের এবং আসামে বাংলাদেশি তাড়ানোর অছিলায় এমন বিভৎস উচ্ছেদ অভিযান কেন?

ভারত কী অর্থনীতিতে নয়াউদারবাদ ও রাজনীতিতে বর্তমান চিনা পথ অনুসরণের জাতীয় বিকাশের রণনীতির এক ককটেল তৈরি করছে? সমগ্র দেশজুড়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ম্যানুফেকচারিং নেটওয়ার্ক, মাও আমলের ভূমি সংস্কার ও সমবায়িক উৎপাদন, বিশ্বশক্তি হিসাবে চিনের উত্থানের ফলে বাইরে থেকে চিনের অভ্যন্তরে মূল্যের ট্রান্সফার, একদলীয় শাসন, রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের শক্তিশালী উপস্থিতি ইত্যাদির যে সুবিধা চিনের রয়েছে, তার কোনটাই ভারতের নেই। উন্নয়শীল দেশগুলির মধ্যে ভারত খানিকটা এগিয়ে এই কারণেই যে "কারেন্সি একচ্যাঞ্জ রেট" রিজিম ভেঙে বাজার-নির্ভর করার ক্ষেত্রে ভারত দীর্ঘ সময় নিয়েছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে ইউপিএ জমানায় সরকারের উপর ভারতীয় বৈচিত্র্য ও গণতন্ত্রের চাপ থাকার ফলে। এনডিএ জমানায় সেই চাপ ভেঙে ফেলার আয়োজন করা হচ্ছে এবং এক দমনমূলক রাষ্ট্রবাদ চালুর প্রচেষ্টা চলছে। 

সেই রাষ্ট্রবাদ টিঁকে থাকবে কীসের উপর ভিত্তি করে? সেই ভিত তৈরির আয়োজন করতে মরিয়া হয়ে লেগেছে বিজেপি সরকার, এক বিকৃত পুঁজিবাদী বিনিয়োগ ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে চাইছে। দেশীয় পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ সম্ভব অনুন্নত-প্রযুক্তির উৎপাদন-প্রক্রিয়ায়, যেমন মাইনিং, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিকাঠামো ইত্যাদি। হাই-টেকনোলজিতে যেতে হলে চিনের ও প্রধানত আমেরিকার উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু ৯০ শতাংশের অধিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে এক ক্ষুদ্র উচ্চ ও মধ্যবিত্ত উপভোক্তার চাহিদার বাজার দিয়ে এই দেশীয় বিনিয়োগকে লাভজনক বিনিয়োগ হিসাবে কীভাবে টিঁকিয়ে রাখা সম্ভব, যখন বিশ্ব রপ্তানী বাণিজ্যে ভাঁটার টান চলছে, যখন উৎপাদনে কাঁচামালের চাহিদা কমছে, যখন ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে চাহিদার সংকট উৎপাদনী হাতিয়ার উৎপাদনের সেক্টরকেও গ্রাস করে নিচ্ছে? পুঁজিবাদের নিজস্ব বিকাশের গতিকে আঁটকে দিয়ে ভারত সরকার তার সমাধানে মিলিটারি উৎপাদনী বিনিয়োগে গুরুত্ত্ব দিচ্ছে, কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা। কর্মসংস্থান তৈরির বদলে কর্মসংকোচনের মাধ্যমে সস্তা শ্রম ও সম্পদের যোগান নিশ্চিত করে "রাষ্ট্রবাদ" টিঁকে থাকতে পারে না, বড়জোর সাময়িক কিছু রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করা যেতে পারে, কিন্তু ভারতীয় নির্বাচনী গণতন্ত্রও তাতে পথ আগলে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। অথবা এক অত্যাচারী স্বল্পম্যাদী শাসনব্যবস্থা সার্বিক বিশৃঙ্খলা কিংবা নতুন সমাজবাদী রাজনীতির জন্ম দিতে পারে। 

আসামের মিনারেল রিসোর্স লুট করা নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক পরিসরে আলোচনা চলছে। আসামে তেল, গ্যাস, কয়লার উপস্থিতির কথা আগে যেটুকু জানা ছিল, সেখানেও বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমেছে বৈ বাড়েনি। মেঘালয়ের কয়লা আধুনিক টার্বাইনের জন্য উপযোগী কী না এনিয়ে মতান্তর আছে। শালেকাঠি তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যক্তিগতকরণেও লাভজনক হয়নি। সুতরাং মাটির নিচের সম্পদ থাকলেই যে তার উত্তোলনে লাভজনক বিনিয়োগ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, আর ব্যক্তি পুঁজি অনিশ্চয়তার বাজারে এতো বৃহৎ বিনিয়োগে আসবে না, রাষ্ট্রের লোন নেওয়ার সুযোগও সীমিত। অভ্যন্তরিণ বাজার থেকে লোন নেওয়ার সুযোগ কম, বিদেশী লোন নিলে পরনির্ভরতা ও লুটপাট এবং দেশের জনগণকে আরও সংকটের মধ্যে ঠেলে দেবে। তাতে রাষ্ট্রবাদ কী করে টিঁকে থাকবে? তথাপি বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রবাদী বিজেপির মরিয়া প্রয়াসে উচ্ছেদের রাজনীতি ছাড়া বিকল্প নেই। তাদের জন্য ক্যাচ-২২ সিচ্যুয়েশন।

কিন্তু আসামের উচ্ছেদের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বিজেপি সরকার যে সাময়িক সাফল্য আশা করছে, তার ভিত্তি কী? এর বিরুদ্ধে কী কোন রণনীতি রচিত হতে দেখা যাচ্ছে? স্মরণে রাখবেন, বিজেপির রাষ্ট্রবাদের বিপরীতে কংগ্রেসের বৈচিত্র্যবাদ অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কোন পার্থক্য রচনা করছে না। এক অদ্ভূত বিরোধ, যেখানে ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হলেও অর্থনীতিতে মিল -- এই অন্তর্নিহিত বিরোধের মীমাংসা কীভাবে হবে সেটা এখনই বলা মুস্কিল। কর্ণাটকে কংগ্রেস সরকার শ্রেণিসংগ্রামের চাপে পিছু হঠছে, বিজেপির মত আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে না, কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের চাপ যেখানে নেই সেখানে অর্থনীতিতে বিজেপির মত আচরণ করছে।

আসামের সমাজের গভীরে চূড়ান্ত হতাশার পরিবেশ।মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত সন্তানদের কোন "কোয়ালিটি জব" কিংবা সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন চাকুরির নিশ্চয়তা নেই, সার্বিক বেকারত্ব সমাধানের কোন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সমাজের এই অংশটি, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও, যে কোন প্রলোভনে বিশাল কায়িক শ্রমজীবীদের সুরক্ষার বিষয়কে পদদলিত করতেও দ্বিধাবোধ করছে না, তাদের কাছে এক ডেসপারেট পরিস্থিতি যেখানে নতুন সমাজ-গঠনের বিকল্প রাজনীতির স্বপ্নও অনুপস্থিত।  

আসাম সরকার যখন সার্বিকভাবে আম-জনতার উপর উচ্ছেদের আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, তখন যে জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ নামিয়েছে তদের মধ্যেও প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ সামাজিক ভিত বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে, এমনকি বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও। কীভাবে? তার উত্তরে সবাই বলবে, জনগোষ্ঠীগত বিভাজন তৈরির রাজনীতি।

কিন্তু আক্রমণ যখন সর্বগ্রাসী, তখন জনগোষ্ঠীগত ঐক্য গড়ে ওঠার বাস্তবতা দেখা দেয় এবং সেই ঐক্য গড়ে ওঠার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, সেজন্যই বিজেপি সরকার চিন্তিত। কিন্তু তাদের একটা পরিস্থিতিগত সুবিধাও রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে মধ্যশ্রেণির অংশ এই উন্নয়ন মডেলের বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ মানসিকভাবে মানতে না পারলেও, নিজের জনগোষ্ঠীর শ্রমজীবীদের স্বার্থ বলিদান দিয়ে উন্নয়নের কাজের ঠিকা, সাপ্লাই এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের আশায় শাসকের পক্ষ নিয়ে নিতে পারে, এমনকি আজকের এই হতাশাজনক ও বিকল্পহীন আর্থিক-রাজনীতির পরিবেশে এরা অর্থ রোজগারের আশায় নিজ জনগোষ্ঠীর সস্তা-লেবার সাপ্লায়ার হতেও পিছপা না হতে পারে। অর্থাৎ শাসকের কাছে অত্যন্ত ভঙুর হলেও মধ্যস্তত্ত্বভোগীর এক স্তরতন্ত্রের কাঠমো তৈরির সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে সেই পরিস্থিতিতে যখন বিকল্প সমাজ-গঠনের রাজনীতির কোন স্বপ্নও অনুপস্থিত। আর জনগোষ্ঠীগতভাবে বিভাজিত শ্রমজীবীরা যখন তাদের সমাজের একাংশ শ্রেণিকে শাসকের পক্ষ নিতে দেখে, তখন তারা আত্মসমর্পণে ও ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। 

সুতরাং উচ্ছেদের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে উচ্ছেদ করতে হলে দ্রুত শ্রমজীবীদের ঐক্য গড়ার, শ্রমজীবীদের সংগঠন গড়ার প্রতি মনোনিবেশ ও ফোকাস রাখতে হবে, একাজটি দ্রুত করতে হবে গণসংগ্রাম ও নির্বাচনী সংগ্রামের অভ্যন্তরেই। শ্রমজীবীদের সংগঠন ও সংগ্রামের বিকাশ বিকল্প রাজনীতির ন্যারেটিভকেও মূলস্রোতে নিয়ে আসবে। পঞ্চায়েতের ও গ্রামসভার হাতে অধিক ক্ষমতা, আমূল ভূমি সংস্কার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে স্থানীয় বিনিয়োগের সরকারি সুবিধা ও সুরক্ষা এবং সর্বোপরি সমবায়িক উৎপাদনের বিষয় সংগ্রামী এজেণ্ডায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সংগ্রামের গর্ভে ধীরে ধীরে স্থান করে দিতে হবে।

 

Posted by স্বাভিমান

 

ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দুর্বলতা

বিগত শতিকার আশির দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে ট্রেড-ইউনিয়নের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। বামপন্থী ট্রেড-ইউনিয়নের ভূমিকা শুধু  নির্দ্দিষ্ট শিল্পের অভ্যন্তরে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যেকার দর-কষাকষিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, রাষ্ট্র ও  রাজনীতিকে সমাজবাদের দিকে পরিচালিত করার অক্ষ হিসাবেও ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ারকে পরিচালিত করার লক্ষ্য ছিল।১৮৫০ সালের পর রেলপথ নির্মাণের ফলে বোম্বে, কলকাতা, বিহারে যে অসংখ্য জুটমিল ও কয়লাখনি গড়ে ওঠে তাতে শিল্প-শ্রমিকের উদ্ভব ঘটে। শ্রমিকের উপর অতি-শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ধর্মঘট ছিল তখন স্বঃতস্ফূর্ত। ১৯২০ সালে শ্রমিকের অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক ন্যায় ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক লক্ষ্যে গঠিত হয় এআইটিইউসি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, বিশেষ করে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ফলে। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নবরত্ন ইত্যাদির মাধ্যমে শিল্পায়নের ফলে বৃহৎ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ইণ্ডাস্ট্রী ও ফিনান্স সেক্টরে ট্রেড-ইউনিয়নের শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কল্যাণকামী ও বৈচিত্র্যের গণতন্ত্রের নীতিতে প্রতিটি নতুন অভ্যন্তরিণ সামাজিক সংঘাত নতুন নতুন দলের জন্ম দেয় এবং প্রতিটি দল তার নিজস্ব রাজনৈতিক-শক্তি প্রদর্শনে ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ারকে ব্যবহার করতে একেকটি ইউনিয়ন খুলে বসে। রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ক্ষমতার স্বার্থের বাইরে বৃহত্তর কোন রাজনৈতিক লক্ষ্যে ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ার সর্বশেষ ব্যবহৃত হয় ১৯৭৪ সালের রেল ধর্মঘটে যা ইন্দিরা-ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার আত্মশক্তির যোগান দেয়। দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্ষোভের উপর ভিত্তি করে ১৯৭৪ সালের মধ্যবিত্ত বা বুদ্ধিজীবী-শ্রমিকদের পরিচালিত গুজরাটের নবনির্মাণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে বিহারে জয়প্রকাশ নারায়ণের উত্থান ঘটে বটে, কিন্তু ইমার্জেন্সি বিরোধী আন্দোলনের মূল প্রেরণাশক্তি ছিল রেল-ধর্মঘট।

উনিশ আশির দশকের সময় থেকে ট্রেড-ইউনিয়ন মানে রাজনৈতিক দলের হুকুমে পরিচালিত একটি প্রত্যঙ্গে পরিণত হতে শুরু করে, এবং ধীরে ধীরে ডান-বাম সব ট্রেড-ইউনিয়নের ক্ষমতা এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে রাজনৈতিক দলের শক্তির উৎস ট্রেড-ইউনিয়ন থেকে সরে যায়। শ্রম ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার উদারবাদী পুনর্গঠনের ফলে স্থান-কালে বহুধা-বিভাজিত শ্রমিকের সঙ্ঘশক্তি নিঃশেষ করে দেয়। যুদ্ধোত্তর পর্যায়ের ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির নিউ-ডিলের পর্যায় সমাপ্ত হয়ে শ্রমিকের উপর পুঁজির সর্বগ্রাসী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মনোগত ও ঘোষিত লক্ষ্যে বামেরা শ্রমিকের পক্ষ অবলম্বন করলেও, সমগ্র রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে পুঁজি এবং তার পরিণতিতে ডান ও বামের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য করতে জনগণ ব্যর্থ হয়, রাজনীতিবিহীন নৈতিকতার ও বৈচিত্র্যের গণতন্ত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্যে জনগণ কিছুকাল বামেদের আলাদা করে চেনে। কিন্তু রাজনীতিই নিয়ন্ত্রক লেনিনের সেই কথার সূত্র ধরে যখন সমাজ নিজেই দুর্নীতিকে রাজনীতির অঙ্গ বিবেচনা করার মত টিনা ফ্যাক্টরের পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, তখন বামপন্থাকে জনবিচ্ছিন্ন অকর্মণ্য রাজনীতি ভাবতে শুরু করে।

১৮৫০ ব্রিটিশের রেলপথ নির্মাণের সূত্র ধরে শিল্পায়নের মাধ্যমে যে শিল্প-শ্রমিকের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক বিক্ষোভ ও ধর্মঘট হতে শুরু করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালে একমাত্র ট্রেড-ইউনিয়ন এআইটিইউসি গড়ে ওঠে যা স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, সেই গতিপথে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর ওয়েলফেয়ার ইকোনমি।

ওয়াশিংটন কনশেনশাস ভাঙছে, আমেরিকার অভ্যন্তরে ওয়াল স্ট্রিট ও মেইন-স্ট্রিটের সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আনিশ্চিত। পুঁজি আরেকটি পুনর্গঠনের সন্ধানে। জিলে জোঁ থেকে আরব স্প্রিং হয়ে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট এর মত দেশে দেশে শ্রমজীবীদের বিক্ষোভ সমগ্র বিশ্বকে তটস্থ করে রেখেছে, কিন্তু তার রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টেশন ঘটছে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরগুলোর  মধ্যেকার টানাপোড়েনে কিংবা সহাবস্থানে। কোন বিকল্প বাম-রাজনীতিতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। আমেরিকায় বার্ণি-সেণ্ডার্স বাম-ঘেঁষা রাজনীতির আশা জাগিয়ে আমেরিকার বাইপোলার-কনশেন্সাসের একটি মেরু ডেমোক্র্যাটদের সাথে জুড়ে গেলেন। ইউকে’র কর্বিন লেবার পার্টিকেও কাঠগড়ায় তুলে নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পেরেছেন, শ্রমজীবী মানুষ যে বাম বিকল্প চায় সেটা তারও ইঙ্গিতবহ।

এই প্রসঙ্গ আর বিস্তৃত না করে, একথা নির্দ্ধিধায় বলে দেওয়া যায় যে, বাম রাজনীতি এক বিভ্রান্তির অবস্থায় রয়েছে। শ্রমিকের সঙ্ঘশক্তি বা ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ার গড়ে তুলতে পৌনঃপুনিক ব্যর্থতা কোন এক তাত্ত্বিক বিভ্রান্তির দিকে ইঙ্গিত করে। ট্রেড- ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তির সূত্রপাত শ্রেণির ধারণায় বিভ্রান্তি থেকে। ভারতের মত দেশে যেখানে ইনফর্মাল সেক্টর সবসময়ই বৃহৎ সেখানে প্রথমে ধরে নেওয়া হলো শিল্প-শ্রমিকরাই শ্রমিকশ্রেণি। নিওলিবারেল পুনর্গঠনের পর যখন নতুন নতুন বৃহৎ ইনফর্মাল সেক্টরের জন্ম হয়েছে, ফর্মাল সেক্টরের নির্দ্দিষ্ট স্থান-কালে যুক্ত সংগঠিত শ্রমিকের পরিসর প্রায় ভেঙে গেছে, তখন শ্রেণি প্রশ্নে বিভ্রান্তি ট্রেড-ইউনিয়ন শক্তিকে দুর্বল করে কিংবা ইকোনমিজমের গাড্ডায় নিমজ্জিত করে। ইনফর্মাল সেক্টর হচ্ছে এমন একটা সেক্টর যেখানে শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণি-বর্ণের ফিউশন প্রায় সম্পূর্ণ। অথচ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কোন পথের সন্ধান না দিয়ে, বামপন্থীরা রাজনীতির নামে ওটার খানিক সেটার খানিক দিয়ে এক মিশ্রণ পরিবেশন করছেন।

মার্ক্সসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে শ্রেণির হিসাব নেওয়া হয় উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন, আহরণ ও বন্টনের প্রক্রিয়া দিয়ে। সেই হিসাবে সমাজ-ব্যবস্থারও মূল্যায়ন করা হয়। উদ্বৃত্ত শ্রম যখন অর্থের সাথে বিনিময় হয় তখন উদ্বৃত্ত মূল্য এবং যখন সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার বা ভোগ করা হয় তখন উদ্বৃত্ত সামগ্রী হিসাবে দেখা দেয়। উদ্বৃত্ত আহরণের তিনটি বিকল্প রয়েছে। প্রথম দু’টি রূপ বিভিন্ন মাত্রায় আমাদের সমাজে বিদ্যমান। প্রত্যক্ষ উৎপাদক থেকে আহৃত উদ্বৃত্ত সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বন্টিত হয় এবং এভাবেই উদ্বৃত্ত শ্রমজীবীদের শ্রম-প্রক্রিয়ায় এক সূত্রে গাঁথে।

শ্রেণিসংগ্রামের দু’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উদ্বৃত্ত তৈরি ও আহরণকে পরিবর্তনের জন্য লড়াই করা যাতে উৎপাদন খণ্ডের চরিত্র পরিবর্তন হয় এবং উদ্বৃত্তের বিতরণ ও প্রাপ্তির পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম যা শ্রমিকের অস্তিত্বের পরিবেশকে পরিবর্তন করে যা উদ্বৃত্ত তৈরি ও আহরণের চরিত্রকে প্রতিফলিত করে এবং সম্পদের বিতরণ ও প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। পরিবারের অভ্যন্তর থেকে শুরু করে প্রতিটি অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সম্পর্কে এই বিতরণ ও প্রাপ্তির সংগ্রাম নিয়ত চলতে থাকে, এবং সেটাই চলমান শ্রেণিসংগ্রাম, সেখানে ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টকে সম্পদ বা উদ্বৃত্তের সেই অভ্যন্তরিণ আহরণ ও বিতরণ নির্ধারণ করতে হয়, যাতে শ্রেণি-শ্রক্তির ভারসাম্য বোঝা যায় এবং প্রত্যক্ষ উৎপাদকের সংগ্রামকে ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টের সাথে জুড়ে নেওয়া যায়।

একটি নির্দিষ্ট বৃহৎ শিল্পের পরিসরে উদ্বৃত্ত বন্টনের অভ্যন্তরিণ পরিবর্তনগুলো আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি, অ্যারিস্ট্রোক্রেসি লেবার কিংবা মধ্যসত্ত্বভোগী শক্তিশালী হচ্ছে, প্রত্যক্ষ উৎপাদকের থেকে মধ্যস্তত্বভোগীর বহুবিধ স্তর তৈরি হচ্ছে, না সমসত্ত্বা তৈরি হচ্ছে তা আমরা সহজেই যাচাই করে দেখতে পারি এবং সে অনুযায়ী সংগ্রামের রূপ নির্ধারণ করতে পারি।  কিন্তু ইনফর্মাল সেক্টারের বাড়বাড়ন্তে বহুধা-বিভক্ত শ্রমিকেদের মধ্যে এই শ্রম-প্রক্রিয়ার হিসাব নেওয়া বেশ দুরূহ কাজ এবং সমসত্ত্বা্র বৈশিষ্ট্য যে ইউনিয়ন-পাওয়ার গড়ে তোলার উপাদান এবং সমাজ-পরিবর্তনের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে ইউনিয়ন সংগ্রামের নিজস্ব গতিপথে সামিল হওয়ার পূর্বশর্ত তা নির্ধারণ করা কঠিন।

সেক্ষত্রে শ্রেণিকে আমরা শুধু উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন, আহরণ ও বিতরণের বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি না। আমাদের শ্রেণির প্রশ্নটিকে ক্রমাগত পরিবর্তনীয় চেতনার স্তর দিয়ে নির্ধারণ করতে হয়। অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণি আসলে শ্রমিকের অস্তিত্বের এক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া (continuous transformation of being into becoming)এই শ্রমিক কারা? তারা শ্রমজীবীদের বিভিন্ন অংশ যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণের কিংবা উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্য বা সামগ্রীর ভাগ-বাটোয়ারার সংঘাতের বহুবিধ চেতনাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ শ্রমিকরা অর্থনৈতিক ও সামজিক দিক থেকে বহুবিধ ক্যাটাগরির। কিন্তু বিশাল সার্ভিস সেক্টরের দুনিয়াতে ইনফর্মাল শ্রমিকদের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্যাটাগরির একটা “অটোম্যাটিক ফিউশন” প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। অথচ বহুধাবিভক্ত শ্রমিক যেহেতু কোন সমস্তত্বাকে প্রতিনিধিত্ব করে না, ফলে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে রূপান্তর ঘটে না। তাই শ্রেণির প্রশ্নকে নির্ধারিত করতে হবে তার সংগ্রামের গর্ভে। শ্রেণিকে তার সংগ্রাম থেকে আলাদা করে দেখার এবং সংগ্রামী ঐক্যের মাধ্যমে চেতনার যৌথতার দিকে ক্রমাগত পরিবর্তন ও উল্লম্ফনের মাধ্যমে শ্রেণির ধারনাকে আত্মস্থ না করতে পারার যান্ত্রিকতা ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টে বাম-বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়েছে।

গণিতের ভাষায় শ্রেণিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় ঃ The continuous derivative of a function of a matrix which contains various economic and social categories as its variable elements.

Posted by স্বাভিমান

 গরুখুটি, গরু, কৃষক-শ্রমিক ও বাম – রাজনীতি

গরুখুটির কৃষি ও ডায়েরি প্রকল্প উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের কৃষি-সমবায়ের অধীনে আনা হোক।

 

দরং জেলার শিপাঝার রাজস্বচক্রের অভিশপ্ত গ্রাম গরুখুটি আবারও সংবাদ শিরোনামে। অভিশপ্ত এই কারণে যে ২০২১ সালে এবং ২০২৫ সালে দু’দুবার প্রচারের আলোকে এসেছে বাসিন্দাদের বিপর্যয়ের প্রতীক হিসাবে।

২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, বিশাল পুলিশ বাহিনী ও বুলডোজার নিয়ে গরিব চাষিদের উচ্ছেদ অভিযান। ১২ বছরের এক নাবালক সহ পুলিশের গুলিতে দুইজনের মৃত্যু ৯৬৬ পরিবারের ৭০০০ কৃষিজীবীদের উচ্ছেদ।

যে কোন মানবিক পরিস্থিতি দেখা দিলে হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়া সেই বিখ্যাত “শকুন ও একটি ছোট্ট মেয়ের” ছবি আজও বিশ্ববাসী স্মরণ করে। ২০১১ সালে জানা যায় সুদানের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এই ছোট্ট শিশুটি ছিল ছেলে যে হামাগুড়ি দিয়ে আধ কিলোমিটার দূরে রাষ্ট্রসংঘের ত্রাণশিবিরের দিকে যাচ্ছিল এবং সে নাকি বেঁচেও যায়। এই ছবির জন্য চিত্রকার পুলিৎজার পুরষ্কার পান। কিন্তু পুরষ্কার পাওয়ার চার মাস পরে অন্তর্দহনে আত্মহত্যা করেন। কেন তিনি ছবি না তোলে শিশুটিকে বাঁচাতে গেলেন না, এই প্রশ্ন তাঁর মনকে বিদীর্ণ করছিল। 

সেদিন গরুখুটিতে উচ্ছেদ অভিযানে পুলিশের সাথে যাওয়া এক ফটোগ্রাফারকে ঠিক তার বিপরীত ভূমিকায় দেখে বিশ্ববাসী আঁৎকে উঠেছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছিল পুলিশের গুলিতে নিহত এক কৃষকের মরদেহের উপর উঠে এক চিত্রকারের উদ্যাম নৃত্য। সমাজের অভ্যন্তরে কতটা ঘৃণার চাষ হলে এমন বর্বর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। উচ্ছেদ হওয়া লোকরা ছিল গরিব মুসলিম চাষি।

 ঘটনার পর সরেজমিনে সমীক্ষা করতে “জন হস্তক্ষেপ” সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জওহর লাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ড০ বিকাশ বাজপাই, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশবন্ধু কলেজের অধ্যাপক বিশ্বজিত মহান্তি এবং ওড়িষ্যার বরিষ্ঠ সাংবাদিক ও সমাজকর্মী শ্রী সুধীর পট্টনায়েক আসেন। উচ্ছেদ অভিযানের পর গরুখুটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে লিখিত কোন বাধা না থাকলেও, গোটা এলাকা পুলিশ আরক্ষী বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল, বাইরের পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ অলখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের গুয়াহাটির কর্মকর্তারা স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহযোগিতায়  নদিপথে নৌকা দিয়ে ও বাকী পথ মোটরবাইকে অকুস্থলে পৌঁছার আয়োজন করেন এবং গরুখুটি ১, ২ এবং ৩ নম্বর গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলার সুযোগ ঘটে। সাথে ছিলেন অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতেও সেখানে সভা করা হয় এবং গুয়াহাটী চচলের উচ্ছেদ বিরোধী সমাবেশেও সেখান থেকে গ্রামবাসীরা যোগ দেন। জন হস্তক্ষেপের জারি করা দীর্ঘ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ৯ জুন ২০২১ সালেই সরকার ঘোষণা করে দিয়েছিল যে ৭৭০০০ বিঘা জমি ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করা হয়েছে, এবং মন্ত্রী – এমএলএ’দের বলা হয়েছে তা ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নিতে। ৭৭০০০ বিঘার অর্ধেকের বেশি জমি ব্রহ্মপুত্রের নদি-ভাঙনে আগেই তলিয়ে গেছিল। উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় কোন আইন-কানুন মানা হয়নি। প্রতিবেদন ২০১৯ সালের কর্পোরেট-বান্ধব ভূমি  নীতি বাতিলের দাবি জানায়। এই ঘটনার উপর ঘটিত তদন্ত কমিশন ২০২৪ সালে রিপোর্ট জমা দেয়, রিপোর্টে জোরজবরদস্তি উচ্ছেদের জন্য সরকারের সমালোচনা করে এবং ষোলটি পরামর্শ দেয় যার মধ্যে আসাম ল্যাণ্ড ও রেভিন্যু রেগুলেশনে যে দুর্বলতাগুলি আছে তা দূর করার পরামর্শ অন্যতম।

 সাম্প্রদায়িক সামাজিক বাতাবরণকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘু অঞ্চলে উচ্ছেদ অভিযানকে সামাজিক মান্যতা প্রদানের চেষ্টা হলেও কর্পোরেট স্বার্থ হিন্দু-মুসলিম বিচারে আগ্রহী নয়, ফলে উচ্ছেদ এখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র এক রাষ্ট্রীয় অভিযান হিসাবে পরিণত হয়ছে, জনগণও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। সরকারকে জনগণের মনের কথা শুনতেই হবে।

 

এই উচ্ছেদ অভিযান কেন? সেখানে কমার্শিয়াল ডায়েরি ফার্মিং প্রকল্প করা হবে যার জন্য ইউনিট প্রতি ৫০ লাখ টাকা সরকারি ভর্তুকি থাকবে। ৫.৫ কোটি টাকার গরুখুটি এগ্রিকালচারেল প্রজেক্ট হবে। প্রথমটির জন্য গুজরাট থেকে ৩০০ গির গরু আনা হয়, কিন্তু প্রজেক্ট পরিত্যক্ত হওয়ায় কংগ্রেস দলনেতা গৌরব গগৈ অভিযোগ তোলেন যে আসলে প্রজেক্টের নামে গরুগুলি শাসক দলের  মন্ত্রী এমএলএদের সস্তায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী তার জবাবে বলেছেন, গরুগুলি অসুস্থ হওয়ায় প্রজেক্ট স্টাফরা তা ম্যানেজ করতে পারছিল না, তাই এমএলএ মন্ত্রীরা সস্তায় কিনে নেন। এরপরই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বহুল ব্যবহৃত ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন, তিনি বলেন, গোমাংস ভক্ষনকারীরা কীভাবে গরু চুরির ও সুরক্ষার কথা বলে।

সামগ্রীক বিচারে বিষয়টি শুধু দুর্নীতির নয়, নির্বাচনী তরজা হিসাবে দুর্নীতির বয়ানবাজী চলতে থাকবে, আর সমাজে দুর্নীতিও চলতে থাকবে। উচ্ছেদ হওয়া ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ দুর্নীতির এই তরজায় কতটা প্রভাবিত হোন বলা মুস্কিল, তাদের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয় তাদের জীবনের দুর্দশা থেকে। সেই হিসাব থেকে আমাদের সমাধানের পথ খুঁজতে হয়।

ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায় যে উচ্ছেদ ও উচ্ছেদ-পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম কিছু ধনি লোক উচ্ছেদের পক্ষে ও উচ্ছেদের পর আইনি ও গনতান্ত্রিক সংগ্রামকে প্রশমিত করতে মুসলিম কৃষক ও মেহনতি মানুষদের বাগে আনার ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কেন এরকম ভূমিকা নিলেন? কারণ একদিকে বর্তমানের প্রেক্ষিতে তাদের জমানো অর্থকে উৎপাদনী পুঁজিতে রূপান্তরিত করার জন্য আমজনতাকে সাথে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করার মত শ্রেণিশক্তি ও মানসিকতা তাদের নেই, অন্যদিকে কর্পোরেট মানি-পাওয়ার এতোটাই শক্তিশালী যে শুধু তাদের নিজস্ব পুঁজির মুনাফার স্বার্থ নয়, সরকারি অর্থও কীভাবে ব্যয় হবে সেই রাজনীতিকেও নির্ধারণ করে। ফলে কর্পোরেট ও সরকারি পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে রেন্ট-মুনাফার যে ভ্যালু-চেইন তাতে ছোট শরিক হিসাবে মেজোরিটির দালালদের তলায় সংখ্যালঘু দালাল হিসাবে তাদের প্রবেশ ঘটে, সেই সুবাদে টাকা খাটিয়ে কিছু আয় করে নেওয়া যায়।

ফলে উন্নয়নের এমন একটি আধুনিক ও উপযোগী কৃষি ও দুগ্ধ প্রকল্পও লুণ্ঠণের উদ্যোগে পরিণত হয়। আমরা চাই না কোন সম্প্রদায় পশ্চাদপদ ভূমি-সম্পর্কে পড়ে থাকুক, আমরা চাই না উৎপাদনের আধুনিক উপকরণ ব্যবহার বাধাপ্রাপ্ত হোক। কিন্তু আধুনিকতার নামে যেভাবে উচ্ছেদ করে নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যেভাবে সরকারি বিনিয়োগের দুর্নীতি ও কর্পোরেট পুঁজির লুণ্ঠনকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তাতে গ্রামীণ স্বনির্ভর অর্থনীতির আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, ল্যুম্পেন কালচার ও দালালি আয়ের বাতাবরণে সামাজিক বিকৃতি দেখা দেবে। সরকারকে এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী গোমাংস ভক্ষণের সাথে এই ইস্যু জুড়ে দিয়ে, প্রকারান্তরে গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমিকের অধিকারের উপর দাঁড়িয়ে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার রাজনীতিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। এখানেই বাম-রাজনীতির উত্থানের প্রাসঙ্গিকতা। এটা অনস্বীকার্য যে আসামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কৃষক ও শ্রমিকের সবচাইতে বড় অংশ বাঙালি-মুসলমান। পশচাদপদ কৃষি অর্থনীতিতে তাঁরা কৃষি-উৎপাদনের জন্য গো-পালন করতেন, আবার সেই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গো-মাংস ভক্ষনের জন্য গরু বিক্রি করতেন – এই প্রাণি-হত্যা নিছক হত্যা নয়, এটা জীবন ও প্রাণশক্তির অঙ্গ।

এখন চাষের জমিতে আর গরু ও লাঙ্গল ব্যববহার হয় না। গ্রামীণ কৃষকরা গরু পালেন এবং  তা পালনের অনুপযুক্ত হলে তা বিক্রি করেন – তাতে তাদের পারিবারিক ভরণপোষণের খানিকটা সাশ্রয় হয়। অর্থাৎ গো-মাংস ভক্ষণ কৃষক পরিবারের সাশ্রয়ের জন্য গ্রামীণ কমার্শিয়্যাল বাজারের চাহিদা তৈরির উপাদান, হিন্দু-মুসলিম সবাই সেই বাজারের চাহিদার জোগান ধরতেই দুধেল গাই ছাড়া দুধ দেওয়া বন্ধ করেছে তেমন গরু কিংবা বলদ বিক্রি করে সামান্য আয় করেন। দেশ বিদেশের কমার্শিয়্যাল বাজারের যোগানদার হিসাবে কারা বড় বড় গোমাংসের ব্যবসায় জড়িত সেটা তো সর্বজনবিদিত।

সুতরাং গোমাংস ভক্ষণের মত একটি আর্থিক ও খাদ্যাভাসের বিষয়কে যখন সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তখন তা শ্রমিক-কৃষকদের উপর গিয়ে আঘাত পড়ে, আঘাত পড়ে স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির অবশিষ্টকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে। কিন্তু উপরের কর্পোরেট ও সরকারি পুঁজির লুণ্ঠনের নিয়মে সেই ধর্ম-রাজনীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বরাকের সুপারি ব্যবসার ক্ষেত্রেও আমরা একই পরিণতি দেখেছি, স্থানীয় ব্যবসায়িদের আত্মসমর্পণ ও ক্ষুদ্র কৃষকদের হাহাকার। সেখানেই বাম-রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা, সেটা শুধু দুর্নীতি বিরোধিতা দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

আমাদের দাবি তুলতে হবে, গরুখুটির কৃষি ও ডায়েরি প্রকল্প উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের কৃষি-সমবায়ের অধীনে আনা হোক।  

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , , , , ,

অসমের প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতি, সৃষ্টি ও ধ্বংস

আমাদের আইনের শাসনে উপনিবেশিক প্রভাব এখনও বিদ্যমান। শোষণ ও অবদমনের বৈধতা  প্রদানই ছিল উপনিবেশিক শাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য। দীর্ঘ সংসদীয় গণতন্ত্রে ও বিচারব্যবস্থার যাচাই প্রক্রিয়ায় নাগরিক ও জনগনের অধিকারের শাসনে্র লক্ষ্যে আইনের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন হয়।  তবে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, বিশ্বশক্তির ভারসাম্য, অভ্যন্তরিণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক  টানাপোড়েন ইত্যাদির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিপরীত যাত্রা চলছে বেশ কয়েক দশক ধরে। উপনিবেশিক কালা আইনের অপব্যবহার, নাগরিক অধিকার খর্ব করার জন্য নতুন কালা আইন জারি এবং আইনের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে নাকচ করে শাসনযন্ত্রকে অত্যাচারী ও অমানবিক করে তোলার প্রচেষ্টা আমরা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দু’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ পরিসর আগে কখনও এভাবে আক্রান্ত হয়নি, বর্তমানে যা শাসনের চরিত্রের আমূল পরিবর্তনকে সূচিত করে।  

সেই পরিসরের প্রথমটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের সাথে জনগণ বা ভোটারের সম্পর্ক যা নাগরিকত্ব আইন দিয়ে সংজ্ঞায়িত। নাগরিক হিসাবে ভোটাররা যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন তারাই সরকার কিংবা আইনসভা পরিচালনা করেন, অর্থাৎ নাগরিক হিসাবে ভোটাররাই সার্বভৌম – দেশের সার্বভৌমত্বের ধারণা তাতেই নিহিত। বেশ কয়েকবার শাসনের সেই ধারণা বাধাপ্রাপ্ত হয় – ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে, ১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধের আবহে এবং ১৯৭৫ সালের অভ্যন্তরিণ বিশৃঙ্খলার অজুহাতে কুখ্যাত ইমার্জেন্সির সময়ে। এসব করা হয় পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে জরুরীকালীন অধ্যাদেশ জারি করে। তাতে আইনের পরিবর্তন করা হয়নি, যদিও এধরনের অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতাই গণতন্ত্রের জন্য বিপদজনক।

নিওলিবারেল অর্থনীতির প্রবেশের প্রথম পর্যায়কে উন্নয়ন ও সামাজিক শান্তির নতুন যুগের সূচনা ভাবলেও, দ্বিতীয় পর্যায় থেকে শাসকশ্রেণি আম-জনতার ক্ষোভ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আঁচ করতে আরম্ভ করে। নাগরিকের সামগ্রীক জীবন রাষ্ট্রের নজরদারি ও হুকুমে পরিচালনার লক্ষ্যে আইনের পরিবর্তন হতে শুরু করে। নাগরিকত্ব আইনের পরিবর্তনে রাষ্ট্র ও নাগরিকের গনতান্ত্রিক সম্পর্কের বিপরীত যাত্রার সেই যুগ তখনই শুরু হয়ে যায়।  

অসমের নির্দ্দিষ্ট বাস্তবতায় “বিদেশি ও বহিরাগত” ইস্যু সবসময়ই এক আবেগিক বিষয়। শাসক যে তার স্থায়ী সমাধান কখনোই চাইতে পারে না, অসমের আলোকপ্রাপ্ত সমাজের এই বোধ হারিয়ে ফেলার জন্যই নাগরিক-অধিকারের বিষয়টি অসমে এক ভয়ানক রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্র অন্যায় আচরণ করবে, তাতে আশচর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বিপদ দেখা দেয় তখনই যখন রাষ্ট্রের অন্যায় সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। ইউরোপীয় ‘সিভিল সোসাইটি’ অর্থে সুশীল সমাজের অস্তিত্ব ভারতেই দুর্বল, অসমের মত প্রান্তিক অঞ্চলে তা যে অত্যন্ত দুর্বল হবে তা বলাই বাহুল্য। সেই সুশীল সমাজ ভাবতেই পারেন যে আইএমডিটি আইন বাতিল হলে বিদেশি সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু বাম-গণতান্ত্রিক শিবিরের একাংশও তা’ই ভেবেছিলেন এবং সেটা বাতিলের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। যে প্রদেশে “বিদেশি ও বহিরাগত” সমস্যা এক বাস্তব সমস্যা যার আবেগিক  ব্যবহারে জন্য শাসক ও শাসনযন্ত্র তাকে জিইয়ে রাখার ও শোষণ-প্রক্রিয়ায় অতি-শোষণের লক্ষ্যে বলপ্রয়োগে শ্রমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে, সেখানে রাষ্ট্রের হাতে এক অমোঘ অস্ত্র তুলে দেওয়ার সামাজিক স্বীকৃতি পেল। নাগরিকত্বের সন্দেহ দেখা দিলে অভিযুক্তের উপরই বর্তাবে অভিযোগ খণ্ডনের দায়। দ্বিতীয়বার এনআরসি’র প্রশ্নে শাসকের সেই ট্র্যাপে পা দিলেন “সুশীল সমাজ” ও বাম-গণতান্ত্রিক অংশ । তাঁরা ভাবলেন এনআরসি হলে অসমে “বিদেশি ও বহিরাগত” সমস্যার ক্লোজার হবে, বাস্তবে এনরাসি ও কা দু’টো আইনই নাগরিকের ঘাড়ের উপর খড়গ হিসাবে ঝুলে রইল। শাসকশ্রেণি উপর এই আস্থা ও ভ্রান্তির সূত্রপাত আসলে নিওলিবারেল অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ থেকে জাত, মুখে তারা যা’ই বলুন না কেন, মানসিক পরাজয় তাতে অন্তর্নিহিত। এবার সবচাইতে বিপদজনক ন্যারেটিভ অসমের রাজনীতিতে তৈরি হতে চলেছে।

অসমে “পুশব্যাক” এই জমানার বিষয় নয়। কিন্তু আইনের বাধা এড়িয়ে গোপনে সেটা করা হত। এবার ১৯৫০ সালের অভিবাসী বহিষ্কারের এক আইনকে ব্যবহার করে পুশব্যাকের উপর আইনি জামা পড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, প্রয়োজনে আসাম রুলসের সংশোধনও করে নেওয়া হতে পারে। ১৯ লাখ এনআরসি ছুট, অসংখ্য ডি-ভোটার, ট্রাইব্যুনালের ভুলে লক্ষাধিক “ঘোষিত বিদেশি” ভারতীয় নাগরিকদের উপস্থিতিতে কী ধরনের সামাজিক ভয়ের পরিবেশ তৈরি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সেটা নির্বাচনী তুরুপের তাস হিসাবে অতীব কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহৃত হতে পারে।

দ্বিতীয় যে পরিসরটির রাষ্ট্র সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে সেটা হলো সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন। আইনের চোখে সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে সবাই সমান। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ আইন, কৃষি বিল, শ্রম কোড ইত্যাদির মাধ্যমে আম-জনতার সম্পত্তির ও আয়ের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র যখন ইচ্ছা তখনই আম-জনতার সম্পত্তির উপর বুলডোজার চালাতে পারে, সম্পত্তি কাকে দেওয়ার জন্য? ব্যক্তিমালিক কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে এ হলো রাষ্ট্রের সেবা। এই প্রশ্নে কোন গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ হলে, রাষ্ট্র কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার বহুবিধ নজির ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। এই প্রতিরোধের আবহেও নিওলিবারেল আত্মসমর্পণ একেবারে স্পষ্ট। এবং ফলে শাসক এই প্রশ্নেও একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।    

অসমের রাজনীতিতে এই দু’টি বিষয়ের সাথে শ্রমিকের অধিকারের প্রশ্ন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, কারণ শাসকের এধরনের অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক ভূমিকার পেছনে আসল চালিকাশক্তি হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজির জন্য সস্তা শ্রম ও সস্তা সম্পদের যোগান ধরার বাধ্যবাধকতা।

আর শাসকের সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের পেছনে আসল রহস্য হচ্ছে বিরোধী শিবিরের ভূমিকা ও “সুশীল সমাজের” বিভ্রান্তি। বিরোধীরা পুঁজির মালিককে অসন্তুষ্ট করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিসরে নির্বাচনী রাজনীতি করতে অক্ষম। ফলে রাষ্ট্রের আচরণের ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র” মত। এমনকি বাম-বিরোধী শিবিরের একাংশেরও এই প্রবণতা ক্রমশঃ প্রকট হচ্ছে। সম্প্রতি সিপিএম দল কেরালা সরকারের ভূমিকার উপর সিলমোহর লাগাতে নতুন এক নীতিগত অবস্থান নিয়ে ব্যক্তি-পুঁজির গুরুত্ত্বকে সমাজবাদী গঠন প্রক্রিয়ার বাস্তবতার অঙ্গ হিসাবে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তের কী অর্থ? রাষ্ট্রীয় মালিকানার অর্থ যে সমাজবাদ নয়, সেটা সবাই স্বীকার করে, কিন্তু সেটি অবশ্যই একটি  প্রয়োজনীয় শর্ত – আবার ব্যক্তি-মালিকানা হলেই যে তা সমাজবাদী শ্রেণিসংগ্রামের দ্বারা প্রভাবিত হবে না সেরকম কোন স্বতঃসিদ্ধ নিয়মও কেউ ঘোষণা করেনি। কিন্তু নেহেরু-ইন্দিরা জমানায়, সিপিএম রাশিয়া থেকে আবিষ্কার করল যে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সমাজবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এবার বাজপেয়ী – মোদী জমানায় চিন থেকে আবিষ্কার করল ব্যক্তি-মালিকানা সমাজবাদী গঠন-প্রক্রিয়ার অঙ্গ। প্রথমটি ছিল রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের কাছে আত্ম-সমর্পণ, দ্বীতিয়টি নিওলিবারেলিজমের কাছে।  

অ-বাম বিরোধী শিবিরের দুর্বলতা আরও এককাঠি উপরে। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে “রাষ্ট্র-সর্বেসর্বা” করার যে আইনি আয়োজন চলছে, তাতে প্রাথমিকভাবে টার্গেট মুসলমানরা। কারণ, তারা মূলত কৃষিজীবী, তারা মূলত দক্ষ কায়িক-শ্রমিক, তারা সংখাগুরু ধর্মের কাছে মূল অপর ধর্ম। ফলে বিরোধীরা রাষ্ট্রের ভূমিকার বিরোধিতা করতে গিয়ে সেই আশঙ্কায় ভোগেন যে, সংখ্যাগুরুর ভোট না হাতছাড়া হয়, যদিও সেই আশঙ্কাকে গুরুত্ত্ব দিয়ে তাদের বিশেষ প্রাপ্তি ঘটেনি। কিন্তু শাসকরা তাতে মেজোরিটির সামাজিক স্বীকৃতি লাভে সফল হয়েছে, প্রথম পর্যায়ের বিজয় হাসিল করে নিয়েছে। সেই স্বীকৃতির জোরেই এবার এই নীতি প্রসারিত হচ্ছে অমুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের উপর। কিন্তু তার সার্বিক বিরোধিতার নৈতিক অবস্থান খুইয়েছে বিরোধী শিবির।

অতি-ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অতিমানব রাজনেতা তৈরি হয়। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সাথে ব্যক্তিক্ষমতারও কেন্দ্রীভবন ঘটে। অসমে কংগ্রেস শিবির সেখানে চ্যালেঞ্জ জানাতে গৌরব গগৈকে হাজির করেছেন। সেখানে ব্যক্তি-ইমেজ ভাঙাগড়ার রাজনৈতিক নাটক অব্যাহত আছে। কিন্তু শাসক শিবির তার দলের নির্বাচনী নেতৃত্বের ইমেজ-বিল্ডিংকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যেখান থেকে সাধারণ জনগণ ভাবতে শুরু করে যে ব্যক্তি নিজেই আইন।

অথচ সাধারণ জনতাই নির্বাচনে ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক। পুঁজির শোষণ, তথাকথিত উন্নয়নের যাঁতাকল, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত সাধারণ ক্ষোভিত মানুষ সমাধান চাইছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। কিন্তু সর্বশক্তিমানের কাছে, ভাষা-ধর্মের মধ্যবিত্ত অপর সৃষ্টির রাজনীতির কাছে মানুষ তখনই আত্মসমর্পণ করে, যখন বিকল্প কোন সচেতন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পরিসর অনুপস্থিত থাকে। যে রাজনীতি অমানবিক পুশব্যাককে আইনি বৈধতা দেয়, এবং অমানবিকতাই রাজনৈতিক ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা হিসাবে মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়, তাকে প্রতিহত করতে পারে রাজ্যব্যাপী বিকল্প ভাবনার সামাজিক জাগরণ ও রাজনৈতিক আর্টিকুলেশন।  

বিরোধী শিবিরের সেদিকে বিশেষ নজর নেই, তারা চাইছেন মানুষের ক্ষোভ, মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার নেতা এবং দুর্নীতির ইস্যুতে নির্বাচন লড়ে নিতে। কারণ তারা জানেন, যে দল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে সেই দলকেই কর্পোরেট পুঁজি মদত দেবে যদি বিনিময়ে তাদের স্বার্থ দেখা হয়, এই ব্যাপারে বিরোধী শিবির বিজেপি’র নীতি থেকে খুব বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন না। অসমের এক বড় সংখ্যক ভোটার চা-শ্রমিক, সেই শ্রমিকদের অধিকারের বিষয় উত্থাপনে নরম-হিন্দুত্বের রাজনীতিও ত্যাগ করতে হয় না, তথাপি চা-শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্নে নীরবতা রহস্যজনক। ফলে হার-জিতের খেলা চলছে ধ্বংসের আঙিনায়।                 

সমগ্র বিশ্বে এক ধ্বংসের আবহ বিরাজ করছে। ভারত তথা অসম কোন ব্যতিক্রম নয়। তথাপি অসম সেই মানদণ্ডেও এক বিশেষ উল্লেখ দাবি করে। মিথোলজির আধুনিক ধ্বংসের পুনর্ণির্মাণ।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় একই সময় প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠার ঊষালগ্ন। ইতিহাসবিদরা এই প্রাচীন সময়কে কো-অ্যাক্সিয়্যাল পিড়িয়ড বা একই-অক্ষের সময়কাল হিসাবে চিহ্নিত করেন। প্রাচীন সভ্যতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্ব ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে হতবাক হওয়া অনুসন্ধিৎসা। এর থেকেই জন্ম নেয় মিথোলজি’র দেবতাদের। ভারত গ্রিক সহ প্রায় সভ্যতাতেই মিথোলজির কাহিনীর সাযুজ্য রয়েছে। দ্বেষ, হিংসা, ক্রুরতা, ক্ষমতা লড়াইয়ের ভরপুর অসংখ্য দেবতা ও মিথোলজির চরিত্রে। আর এই চরিত্রগুলিই সৃষ্টির প্রতীক।

প্রেম, যুদ্ধ সব মিলিয়ে বারজন গ্রিক অলিম্পিয়ান দেবতার প্রধান জিউস। সৃষ্টির শুরুর সময়ের দেবতা হিসাবে আকাশ অথবা স্বর্গের স্বৈরশাসক ইউরেনাস ও পৃথিবী গায়া’র এক সন্তানের নাম ক্রোনাস। মাতা গায়া’র নির্দেশে ইউরেনাসের মিলনের সময় তাঁর পিতাকে হত্যা করে ক্রোনাস আকাশের দখল নেয়। ক্রোনাস তার বোন রায়াকে বিবাহ করে। কিন্তু মৃত্যুকালে তাঁর পিতা ভবিষদ্বাণী করেনে যে ক্রোনাসের মৃত্যু হবে তাঁর সন্তানের হাতে, সেই ভয়ে রায়া’র কোলে জন্মের সাথে সাথেই একে একে পাঁচ সন্তানকে সে খেয়ে ফেলে। ষষ্ঠ সন্তানকে রায়া গোপনে রক্ষা করে। সেই ষষ্ঠ সন্তান যখন তার পিতার সামনে হাজির হয়, তখন পিতার পেট থেকে বেরিয়ে আসে আগের পাঁচ সন্তান। তাদের এই নবজন্মের জন্য ষষ্ঠ সন্তান জিউস জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে টাইটানদের পরাজিত করে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালের সম্রাট হয়ে বাকী পাঁচ ভাইকে বিভিন্ন ক্ষমতার অধিপতি হিসাবে নিয়োগ করে। এতে তার মাতামহ ও পিতামহ সহযোগিতা করেন। এভাবেই অন্যান্য ক্ষমতার দেবতা হিসাবে আরও ছয় জনকে নিয়োগ করে।

এথেনার জন্মও চিত্তাকর্ষক। জ্ঞানী ও গুণী অলিম্পিয়া-পূর্ব টাইটান দেবী ম্যাটিস জিউসের পরামর্শদাতা, আবার তাদের মধ্যেও ভালবাসার আকর্ষণ রয়েছে। দেবতাদের এক বিবাহ অনুষ্ঠানে জিউস বিভিন্ন রূপে ম্যাটিসের পেছনে ধাওয়া করে, ম্যাটিস পাহাড়ের ছোট গর্তে ঢুকে গেলে সাপ হয়ে ভেতরে গিয়ে ম্যাটিসকে জড়িয়ে ফেলে। জিউস আদর করে দাবি করে যে জিউস ম্যাটিস থেকে বেশি বুদ্ধিমান সেটা প্রমাণিত হলো। প্রত্যুত্তরে ম্যাটিস বলে যে সে যদি ধরা দিতে চাইত না, তাহলে জিউস তাকে ধরতে পারত না। সেটা পরীক্ষা করতে ম্যাটিস ফড়িং সেজে গলিয়ে বেরিয়ে গেলে জিউস গিরগিটি রূপে ম্যাটিসকে গিলে ফেলে। এরপর ম্যাটিসের প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়। ব্যাথার উপসম না হলে ভেতেরে কী আছে তা দেখতে জিউসের মাথা দু’ভাগে কাটলে বেরিয়ে আসে জিউসের কন্যা অতীব রূপসী ও গুনবতী দেবী এথেনা। এভাবে বিশ্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের পরিচয় ঘটার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মিথোলজির দেবতা ও চরিত্র বাড়তে থাকে।

এবার ধ্বংসের পালা। সর্বময় ক্ষমতার অধিকর্তা হিসাবে হাজির রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী রাজনেতা। পরামর্শদাতা দানব পুঁজির প্রেমে পেছনে ছুটতে ছুটতে জল, জমিন, জঙ্গল সব ধ্বংস করে নিচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে মানুষের জীবন জীবিকা। বদলা নিতে উত্তপ্ত হচ্ছে ধরিত্রী। ধ্বংস, যুদ্ধ, তাণ্ডবের দেবতারা জেগে উঠছেন। পৌরানিক মিথোলজির মত সৃষ্টির ক্ষমতা আর দেবতাদের হাতে নেই।  সৃষ্টি, সৌহার্দ্য, শান্তির দূতরা লুকিয়ে আছে মেহনতি জনতার মধ্যে। ধ্বংসের দেবতাদের মধ্যে লড়াইয়ের আবহেই জাগিয়ে তুলতে হবে মেহনতি জনতার সামাজিক শক্তিকে। প্রাচীন মিথোলজিতে ছিল দ্বান্দ্বিকতা – সৃষ্টির জন্য ধ্বংস, প্রেমের জন্য ঘৃণা, ভালবাসার জন্য যুদ্ধ। এবার শুধু ধ্বংসের একমাত্রিকতা, সৃষ্টি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইছে, সেই বিচ্ছিন্নতাই মেহনতির নতুন লড়াই সৃষ্টির নতুন দ্বান্দ্বিকতায়।                    

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

 জল ডিপ্লোমেসি, জল যুদ্ধ ও বানের জল

পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে একটা যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছিল, যদিও সন্ত্রাসীদের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা সন্ত্রাসী প্রাইভেট বাহিনীকে যে রাষ্ট্রীয় মদতে ব্যবহার করে সে অভিযোগ সত্য। শাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর আধিপত্য ও আফগানিস্তানে রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যবহার করার পুরোনো আমেরিকান নীতি – এই দু’য়ের সংশ্লষে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা শাসন ব্যবস্থায় গেড়ে বসে। এই দুষ্টচক্রের ভুক্তভোগী প্রতিবেশী ভারত তো বটেই, পাকিস্তান নিজেও।

এর থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ খোলা ছিল – পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এব্যাপারে নেহরুর আমল থেকে মোদীর আমল কখনও এক শক্তিশালী বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারত কোন সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে? এই উপ-মহাদেশে সব অস্থিরতার জড় নিহিত দেশ-বিভাজনে,  তার পরবর্তী ভূগোলকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বিভাজনের পর? ভারত – পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে উভয়পক্ষই ক্ষমতায় টিঁকে থাকার উপায় হিসাবে ব্যবহার করতে কম কসরৎ করেনি। অথচ পাকিস্তানে গনতন্ত্র বিকশিত হলে ও সামরিক বাহিনীর বিপরীতে রাজনৈতিক-শ্রেণির হাতে ক্ষমতা থাকলে ভারতেরই লাভ। তার জন্য প্রধান শর্ত হলো পাকিস্তানি জনগণের আস্থা অর্জন করা।

দেশ-বিভাজনের পরপরই দু’দেশের মধ্যে জলবন্টন নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রায় আশি শতাংশ অঞ্চল, গুরুত্ত্বপূর্ণ শহর ও ব্যাপক গ্রামাঞ্চল সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের জলের উপর নির্ভরশীল। সেই সময়ে উভয় দেশই সম্পূর্ণ কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি, পাকিস্তানের নগরায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্ধনের পুরোটাই প্রায় জল-বিদ্যুৎ। খাদ্য সুরক্ষা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ অর্থাৎ সামগ্রীকভাবে সমগ্র অর্থনীতি নির্ভরশীল সিন্ধু অববাহিকার জলপ্রবাহের উপর। মোট ছয়টি নদি ভারতের কাশ্মীর উপত্যকা হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। ফলে পাকিস্তানের আশঙ্কা ছিল যে নদির উজানে যদি ভারত জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে পাকিস্তানের ৮০% মানুষের জীবন জীবিকা, বন্যা খরা, ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ভারত উজানে অধিকার দাবি করে  ও পাকিস্তান সেই জল-প্রবাহের উপর অধিকার দাবি করে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর  বিশ্ব-ব্যাঙ্কের মধ্যস্ততায় ১৯৬০ সালে সামরিক শাসক আয়ুব খান ও নেহেরুর শাসনামলে জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই মধ্যস্ততা ছিল ভারতের নৈতিক পরাজয়, বৃহৎ অর্থনীতির পড়শি দেশ হিসাবে দ্বিপাক্ষিক সমাধান করার ক্রেডিট ভারত নিতে পারত। সেই চুক্তি মতে সিন্দু বেসিনের পূবের নদি বিয়াস, রবি ও সুতলেজ এই তিনটির উপর ভারতের প্রাধাণ্য এবং পশ্চিমের চেনাব, ঝিলম ও সিন্ধু এই তিনটির জলের উপর পাকিস্তানের প্রাধাণ্য স্বীকৃত হয়। ভারত ও পাক সংঘাতে এই জলচুক্তি মতে জলবন্টন না করার ঘোষণাকে অস্ত্র হিসাবে ভারত ২০০১, ২০১৬ সালে ব্যবহার করে, এবার ২০২৫ সালে আবারব্যবহৃত হলো। এ নিয়ে পাকিস্তান হুঙ্কার দিলেও, এই মুহূর্তেই যে বিষয়টি নিয়ে কোন উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না, তার কারণ উজানে জল ধরে রাখার মত এমন কোন পরিকাঠামো নেই যা পাকিস্তানে জল-প্রবাহকে ভীষণভাবে প্রবাভিত করতে পারে। যে জলবিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ হচ্ছে তাও শেষ হতে অন্তত ২০৩২ সাল পর্যন্ত যাবে। কিন্তু জলপ্রবাহের তথ্য না দিয়ে পাকিস্তানের জল-ব্যবস্থাপনায় বাধা তৈরি করতে পারে, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই বন্যা সৃষ্টি করে পাকিস্তানের জনগণের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত করার অভিযোগ উত্থাপন করেছে।  জনগণের বিপর্যস্ত অবস্থাকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে ভারত বিরোধী জিগিরকে ব্যবহার করে। এবারও গণতন্ত্রের বিকাশের বদলে এই সুযোগে পাকিস্তানের আর্মি চিফ পদোন্নতি পেলেন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের অবস্থানকে পোক্ত করলেন। 

নেপালের বাণিজ্যের সড়ক পথ, বাংলাদেশের বাণিজ্যের সমুদ্র পথ, পাকিস্তানের জল বন্টন এসব নিয়ে কূটনৈতিক চাপ তৈরির প্রচেষ্টায় যেহেতু সরাসরি জনগণের জীবনযাপনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ফলে এই ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত ফল দেয়। বাংলাদেশ ও   নেপালের সাথে যখন সম্পর্কেটানাপোড়েন চলছে তখন জলচুক্তি স্থগিত তাদেরও শঙ্কিত করবে। এই সবগুলি প্রতিবেশি দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে চিন। ভারত পাকিস্তানের সাথে আপার-স্ট্রিমের যখন সুযোগ নিচ্ছে, তখন সেদিকে সিন্ধু ও সুতলেজের এবং এদিকে ব্রহ্মপুত্রের ভারতের সাথে চিনের আপারস্ট্রিম রয়েছে। চিনের সাথে ভারতের কোন ধরনের চুক্তিও নেই। সুতরাং চিনও ভারতের সাথে একই ধরনের ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে, এনিয়ে দর-কষাকষি করে ভিন্নতর আর্থিক সুবিধাও আদায় করে নিতে পারে। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।  

এবার যখন ভারতের সাথে যুদ্ধোন্মাদনা দেখা দেয়, তখন বাম-গণতান্ত্রিক শিবির থেকে “যুদ্ধ নয় শান্তি” চাই এই দাবি ওঠে। সব দেশের শাসক পরিস্থিতি অনুযায়ী যুদ্ধও চায়, আবারও শান্তিও চায়। তাদের সেই যুদ্ধ ও শান্তির খেলা জাতি’র কাল্পনিক স্বাভিমান ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার আধারে নির্মিত। আর সেই যুদ্ধ ও শান্তির নির্মাণ আসলে পুঁজিপতি শ্রেণির নিজেদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার স্বরূপ দিয়ে নির্ধারিত। যেহেতু প্রতিযোগিতা নির্ধারক, তা’ই আসলে যুদ্ধ অবিরত, ফারাক শুধু সামরিক শক্তি প্রয়োগের চরিত্রে। পুঁজির অভ্যন্তরিণ প্রতিযোগিতার জাতি – রাষ্ট্রগত সহাবস্থানের স্তর হচ্ছে শান্তি এবং তারই ধারাবাহিকতা হচ্ছে যুদ্ধ। দেশ বিভাজন ছিল তারই পরিণতি এবং সেজন্যই ঘনশ্যাম দাস বিড়লা প্রথম দেশ-বিভাজনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ফলে “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” এই বাক্য-বিন্যাসের কোন অর্থ দাঁড়ায় না, যদি তাতে শ্রমজীবীদের ঐক্যের আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন সদর্থক অন্তর্বস্তু না থাকে? ফলে জলবন্টনের মত বিষয় যা  জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকাকে নির্ধারিত করে ও বিপর্যস্ত করে, উভয় দেশের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেই বিষয়কে যদি উত্থাপন করা না যায়,  তাহলে “যুদ্ধ নয় শান্তির” বাম-রাজনীতির কী অর্থ দাঁড়ায়?

ভারতের পড়শি দেশের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হচ্ছে চিন। পুঁজিবাদী শক্তি হিসাবে চিনের উত্থান ও বিশ্ব ব্যবস্থায় তার প্রভাব নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সহ একটি নিবন্ধ অতি সত্বর এক বিশেষ আকাদেমিক জার্নালে প্রকাশ পাবে। এ বিষয়কে এখানে আলোচনায় আনছি না। কিন্তু দেশ – জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গীতেও যদি দেখা যায়, তাহলে ভারতকে চিনের সাথে প্রতিযোগিতা করেই তাকে বিকশিত করতে হবে। আর এর জন্য ভারতকে তার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপর গুরুত্ত্ব দিতে হবে। কিন্তু বিজেপি সরকার কাল্পনিক বিশ্বগুরু সাজার বাসনা থেকে পরনির্ভর বিদেশ নীতির অবলম্বন ও আঞ্চলিক দাদাগিরি ফলাতে গিয়ে প্রতিবেশী সবগুলি দেশে চিনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে।

বিশ্ব-ব্যবস্থায় যখন এক অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলে, তখনই উৎকৃষ্ট সময় স্বনির্ভর অর্থনীতি ও জোট-নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অবলম্বন করার। ব্রিটিশ সূর্য ডোবার ও আমেরিকার বিশ্বশক্তি হিসাবে উত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ের সময় ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। কিন্তু নেহেরু সেই সুযোগের যে সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারেননি বা করেননি তার জন্য বহুলাংশে দায়ি বামপন্থীদের ভুল নীতি ও ব্যর্থতা। শীতল-যুদ্ধের পর্যায়ে জোট-নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করলেও, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বনির্ভর অর্থনীতির বিকাশে যে প্রয়োজনীয় আমূল পরিবর্তনের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল তা নেওয়া হয়নি। তার পরিণতিতে পরবর্তীতে নিওলিবারেলিজমের সাথে সমঝোতা করতে হয়। সেই সমঝোতাকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং একইসাথে বাস্তবকে আড়াল করার জন্য ব্লকবাস্টার কমার্শিয়্যাল মুভির শিল্পকলাকে ব্যবহার করে বিজেপি সরকার।  

এখন বিশ্ব-ব্যবস্থায় আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলছে, নেহেরুর আমল থেকে বাস্তব আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তখন স্বাধীনতার সংগ্রামের রেশ হিসাবে  শাসক দলের মধ্যে  কিছুটা হলেও দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। বামপন্থীরা শ্রেণিসংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেই ভিত্তিতে একটি শিবির হিসাবে শাসনকে প্রভাবিত করার অবস্থায় ছিলেন। ডান দিক থেকে যে বিরোধী ছিল, তারা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। বর্তমানে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই তার বিপরীত। রাষ্ট্রচরিত্রের ধারনায় রাজনৈতিক ফারাক থাকলেও অর্থনীতির প্রশ্নে বিজেপি ও কংগ্রেস প্রতিযোগিতা আমেরিকার ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানদের মতো এক বাই-পার্টিজান বিভাজন।

আসামের বন্যার সাথে সেই অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে আমূল ভূমি-সংস্কারের পরিবর্তে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির জন্য অবাধ জমি দখল, পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। শুধু বাজার ও শহরের কথা ভেবে, কৃষিকে ব্রাত্য করে, বাঁধ দিয়ে নদি নিয়ন্ত্রণের পলিসি প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সুফল দিলেও, এখন শহরবাসীকেও নরক-যন্ত্রণায় ঠেলে দিয়েছে। বেকেন্দ্রীভূত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব সম্ভাবনাকে খারিজ করে বৃহৎ নদি বাঁধ প্রকল্প জনজীবনে যে কতটা অভিশাপ ডেকে আনতে পারে তা উজনি অসমের ভুক্তভোগী জনগণ প্রতিবছর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সরকার নির্বিকার।

অভ্যন্তরিণ এই পরনির্ভর নীতি এবং প্রতিবেশি দেশের প্রতি শাসকীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের বাসনা, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে আত্মসমর্পনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সিন্ধু ও সুতলেজের ক্ষেত্রে যদি চিন (যার সাথে পাকিস্তানের মত কোন চুক্তিও নেই) আপারস্ট্রিমের অন্যায় সুবিধা নিতে চায়, তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের যুক্তি কী থাকবে? তিব্বতে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে চিন শুধু হিমালয়ান রেঞ্জে পরিবেশ ভারসাম্যের ক্ষতি ডেকে আনছে না, ব্রহ্মপুত্রের জলপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিচ্ছে। অসমের খরা ও বন্যায় অসম ও ভারত সরকারকে তখন নিরুপায় দর্শক হওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকবে না। এখনই ভারত সরকার নিরুপায়, ভারতের সাথে আলোচনা না করে চিনের এই প্রকল্পে অনুমোদন নিয়ে অরুণাচল প্রদেশ সরকার আপত্তি জানালেও, ভারত সরকার নীরব।  

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন