Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

 জল ডিপ্লোমেসি, জল যুদ্ধ ও বানের জল

পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে একটা যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছিল, যদিও সন্ত্রাসীদের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা সন্ত্রাসী প্রাইভেট বাহিনীকে যে রাষ্ট্রীয় মদতে ব্যবহার করে সে অভিযোগ সত্য। শাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর আধিপত্য ও আফগানিস্তানে রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যবহার করার পুরোনো আমেরিকান নীতি – এই দু’য়ের সংশ্লষে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা শাসন ব্যবস্থায় গেড়ে বসে। এই দুষ্টচক্রের ভুক্তভোগী প্রতিবেশী ভারত তো বটেই, পাকিস্তান নিজেও।

এর থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ খোলা ছিল – পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এব্যাপারে নেহরুর আমল থেকে মোদীর আমল কখনও এক শক্তিশালী বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারত কোন সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে? এই উপ-মহাদেশে সব অস্থিরতার জড় নিহিত দেশ-বিভাজনে,  তার পরবর্তী ভূগোলকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বিভাজনের পর? ভারত – পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে উভয়পক্ষই ক্ষমতায় টিঁকে থাকার উপায় হিসাবে ব্যবহার করতে কম কসরৎ করেনি। অথচ পাকিস্তানে গনতন্ত্র বিকশিত হলে ও সামরিক বাহিনীর বিপরীতে রাজনৈতিক-শ্রেণির হাতে ক্ষমতা থাকলে ভারতেরই লাভ। তার জন্য প্রধান শর্ত হলো পাকিস্তানি জনগণের আস্থা অর্জন করা।

দেশ-বিভাজনের পরপরই দু’দেশের মধ্যে জলবন্টন নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রায় আশি শতাংশ অঞ্চল, গুরুত্ত্বপূর্ণ শহর ও ব্যাপক গ্রামাঞ্চল সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের জলের উপর নির্ভরশীল। সেই সময়ে উভয় দেশই সম্পূর্ণ কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি, পাকিস্তানের নগরায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্ধনের পুরোটাই প্রায় জল-বিদ্যুৎ। খাদ্য সুরক্ষা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ অর্থাৎ সামগ্রীকভাবে সমগ্র অর্থনীতি নির্ভরশীল সিন্ধু অববাহিকার জলপ্রবাহের উপর। মোট ছয়টি নদি ভারতের কাশ্মীর উপত্যকা হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। ফলে পাকিস্তানের আশঙ্কা ছিল যে নদির উজানে যদি ভারত জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে পাকিস্তানের ৮০% মানুষের জীবন জীবিকা, বন্যা খরা, ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ভারত উজানে অধিকার দাবি করে  ও পাকিস্তান সেই জল-প্রবাহের উপর অধিকার দাবি করে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর  বিশ্ব-ব্যাঙ্কের মধ্যস্ততায় ১৯৬০ সালে সামরিক শাসক আয়ুব খান ও নেহেরুর শাসনামলে জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই মধ্যস্ততা ছিল ভারতের নৈতিক পরাজয়, বৃহৎ অর্থনীতির পড়শি দেশ হিসাবে দ্বিপাক্ষিক সমাধান করার ক্রেডিট ভারত নিতে পারত। সেই চুক্তি মতে সিন্দু বেসিনের পূবের নদি বিয়াস, রবি ও সুতলেজ এই তিনটির উপর ভারতের প্রাধাণ্য এবং পশ্চিমের চেনাব, ঝিলম ও সিন্ধু এই তিনটির জলের উপর পাকিস্তানের প্রাধাণ্য স্বীকৃত হয়। ভারত ও পাক সংঘাতে এই জলচুক্তি মতে জলবন্টন না করার ঘোষণাকে অস্ত্র হিসাবে ভারত ২০০১, ২০১৬ সালে ব্যবহার করে, এবার ২০২৫ সালে আবারব্যবহৃত হলো। এ নিয়ে পাকিস্তান হুঙ্কার দিলেও, এই মুহূর্তেই যে বিষয়টি নিয়ে কোন উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না, তার কারণ উজানে জল ধরে রাখার মত এমন কোন পরিকাঠামো নেই যা পাকিস্তানে জল-প্রবাহকে ভীষণভাবে প্রবাভিত করতে পারে। যে জলবিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ হচ্ছে তাও শেষ হতে অন্তত ২০৩২ সাল পর্যন্ত যাবে। কিন্তু জলপ্রবাহের তথ্য না দিয়ে পাকিস্তানের জল-ব্যবস্থাপনায় বাধা তৈরি করতে পারে, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই বন্যা সৃষ্টি করে পাকিস্তানের জনগণের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত করার অভিযোগ উত্থাপন করেছে।  জনগণের বিপর্যস্ত অবস্থাকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে ভারত বিরোধী জিগিরকে ব্যবহার করে। এবারও গণতন্ত্রের বিকাশের বদলে এই সুযোগে পাকিস্তানের আর্মি চিফ পদোন্নতি পেলেন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের অবস্থানকে পোক্ত করলেন। 

নেপালের বাণিজ্যের সড়ক পথ, বাংলাদেশের বাণিজ্যের সমুদ্র পথ, পাকিস্তানের জল বন্টন এসব নিয়ে কূটনৈতিক চাপ তৈরির প্রচেষ্টায় যেহেতু সরাসরি জনগণের জীবনযাপনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ফলে এই ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত ফল দেয়। বাংলাদেশ ও   নেপালের সাথে যখন সম্পর্কেটানাপোড়েন চলছে তখন জলচুক্তি স্থগিত তাদেরও শঙ্কিত করবে। এই সবগুলি প্রতিবেশি দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে চিন। ভারত পাকিস্তানের সাথে আপার-স্ট্রিমের যখন সুযোগ নিচ্ছে, তখন সেদিকে সিন্ধু ও সুতলেজের এবং এদিকে ব্রহ্মপুত্রের ভারতের সাথে চিনের আপারস্ট্রিম রয়েছে। চিনের সাথে ভারতের কোন ধরনের চুক্তিও নেই। সুতরাং চিনও ভারতের সাথে একই ধরনের ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে, এনিয়ে দর-কষাকষি করে ভিন্নতর আর্থিক সুবিধাও আদায় করে নিতে পারে। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।  

এবার যখন ভারতের সাথে যুদ্ধোন্মাদনা দেখা দেয়, তখন বাম-গণতান্ত্রিক শিবির থেকে “যুদ্ধ নয় শান্তি” চাই এই দাবি ওঠে। সব দেশের শাসক পরিস্থিতি অনুযায়ী যুদ্ধও চায়, আবারও শান্তিও চায়। তাদের সেই যুদ্ধ ও শান্তির খেলা জাতি’র কাল্পনিক স্বাভিমান ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার আধারে নির্মিত। আর সেই যুদ্ধ ও শান্তির নির্মাণ আসলে পুঁজিপতি শ্রেণির নিজেদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার স্বরূপ দিয়ে নির্ধারিত। যেহেতু প্রতিযোগিতা নির্ধারক, তা’ই আসলে যুদ্ধ অবিরত, ফারাক শুধু সামরিক শক্তি প্রয়োগের চরিত্রে। পুঁজির অভ্যন্তরিণ প্রতিযোগিতার জাতি – রাষ্ট্রগত সহাবস্থানের স্তর হচ্ছে শান্তি এবং তারই ধারাবাহিকতা হচ্ছে যুদ্ধ। দেশ বিভাজন ছিল তারই পরিণতি এবং সেজন্যই ঘনশ্যাম দাস বিড়লা প্রথম দেশ-বিভাজনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ফলে “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” এই বাক্য-বিন্যাসের কোন অর্থ দাঁড়ায় না, যদি তাতে শ্রমজীবীদের ঐক্যের আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন সদর্থক অন্তর্বস্তু না থাকে? ফলে জলবন্টনের মত বিষয় যা  জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকাকে নির্ধারিত করে ও বিপর্যস্ত করে, উভয় দেশের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেই বিষয়কে যদি উত্থাপন করা না যায়,  তাহলে “যুদ্ধ নয় শান্তির” বাম-রাজনীতির কী অর্থ দাঁড়ায়?

ভারতের পড়শি দেশের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হচ্ছে চিন। পুঁজিবাদী শক্তি হিসাবে চিনের উত্থান ও বিশ্ব ব্যবস্থায় তার প্রভাব নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সহ একটি নিবন্ধ অতি সত্বর এক বিশেষ আকাদেমিক জার্নালে প্রকাশ পাবে। এ বিষয়কে এখানে আলোচনায় আনছি না। কিন্তু দেশ – জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গীতেও যদি দেখা যায়, তাহলে ভারতকে চিনের সাথে প্রতিযোগিতা করেই তাকে বিকশিত করতে হবে। আর এর জন্য ভারতকে তার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপর গুরুত্ত্ব দিতে হবে। কিন্তু বিজেপি সরকার কাল্পনিক বিশ্বগুরু সাজার বাসনা থেকে পরনির্ভর বিদেশ নীতির অবলম্বন ও আঞ্চলিক দাদাগিরি ফলাতে গিয়ে প্রতিবেশী সবগুলি দেশে চিনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে।

বিশ্ব-ব্যবস্থায় যখন এক অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলে, তখনই উৎকৃষ্ট সময় স্বনির্ভর অর্থনীতি ও জোট-নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অবলম্বন করার। ব্রিটিশ সূর্য ডোবার ও আমেরিকার বিশ্বশক্তি হিসাবে উত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ের সময় ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। কিন্তু নেহেরু সেই সুযোগের যে সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারেননি বা করেননি তার জন্য বহুলাংশে দায়ি বামপন্থীদের ভুল নীতি ও ব্যর্থতা। শীতল-যুদ্ধের পর্যায়ে জোট-নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করলেও, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বনির্ভর অর্থনীতির বিকাশে যে প্রয়োজনীয় আমূল পরিবর্তনের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল তা নেওয়া হয়নি। তার পরিণতিতে পরবর্তীতে নিওলিবারেলিজমের সাথে সমঝোতা করতে হয়। সেই সমঝোতাকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং একইসাথে বাস্তবকে আড়াল করার জন্য ব্লকবাস্টার কমার্শিয়্যাল মুভির শিল্পকলাকে ব্যবহার করে বিজেপি সরকার।  

এখন বিশ্ব-ব্যবস্থায় আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় চলছে, নেহেরুর আমল থেকে বাস্তব আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তখন স্বাধীনতার সংগ্রামের রেশ হিসাবে  শাসক দলের মধ্যে  কিছুটা হলেও দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। বামপন্থীরা শ্রেণিসংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেই ভিত্তিতে একটি শিবির হিসাবে শাসনকে প্রভাবিত করার অবস্থায় ছিলেন। ডান দিক থেকে যে বিরোধী ছিল, তারা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। বর্তমানে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই তার বিপরীত। রাষ্ট্রচরিত্রের ধারনায় রাজনৈতিক ফারাক থাকলেও অর্থনীতির প্রশ্নে বিজেপি ও কংগ্রেস প্রতিযোগিতা আমেরিকার ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানদের মতো এক বাই-পার্টিজান বিভাজন।

আসামের বন্যার সাথে সেই অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে আমূল ভূমি-সংস্কারের পরিবর্তে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির জন্য অবাধ জমি দখল, পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। শুধু বাজার ও শহরের কথা ভেবে, কৃষিকে ব্রাত্য করে, বাঁধ দিয়ে নদি নিয়ন্ত্রণের পলিসি প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সুফল দিলেও, এখন শহরবাসীকেও নরক-যন্ত্রণায় ঠেলে দিয়েছে। বেকেন্দ্রীভূত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব সম্ভাবনাকে খারিজ করে বৃহৎ নদি বাঁধ প্রকল্প জনজীবনে যে কতটা অভিশাপ ডেকে আনতে পারে তা উজনি অসমের ভুক্তভোগী জনগণ প্রতিবছর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সরকার নির্বিকার।

অভ্যন্তরিণ এই পরনির্ভর নীতি এবং প্রতিবেশি দেশের প্রতি শাসকীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের বাসনা, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে আত্মসমর্পনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সিন্ধু ও সুতলেজের ক্ষেত্রে যদি চিন (যার সাথে পাকিস্তানের মত কোন চুক্তিও নেই) আপারস্ট্রিমের অন্যায় সুবিধা নিতে চায়, তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের যুক্তি কী থাকবে? তিব্বতে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে চিন শুধু হিমালয়ান রেঞ্জে পরিবেশ ভারসাম্যের ক্ষতি ডেকে আনছে না, ব্রহ্মপুত্রের জলপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিচ্ছে। অসমের খরা ও বন্যায় অসম ও ভারত সরকারকে তখন নিরুপায় দর্শক হওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকবে না। এখনই ভারত সরকার নিরুপায়, ভারতের সাথে আলোচনা না করে চিনের এই প্রকল্পে অনুমোদন নিয়ে অরুণাচল প্রদেশ সরকার আপত্তি জানালেও, ভারত সরকার নীরব।  

Posted by স্বাভিমান

এই প্রবন্ধটি গত বছর তড়িঘড়ি দু'দিনের মধ্যে লিখেছিলাম একটি ম্যাগাজিনের জন্য, সংগঠকরা এক বিশেষ উপলক্ষ্যে ম্যাগাজিনটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু অনিবার্য কারণবশতঃ ম্যাগাজিনটি বেরোয়নি। আমার এই ব্লগটি বহুদিন যাবৎ অচল হয়ে আছে, সেই নিবন্ধটি এখানে পোস্ট করে ব্লগটি আবার চালু করলাম। 


বরাক উপত্যকার প্রান্তিকতা ও অন্ত্যজ সমাজ ঃ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিশা 
অরূপ বৈশ্য 

 বরাক উপত্যকার অন্ত্যজ শ্রেণির সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে বরাকের প্রান্তিক জীবনগাঁথা। কেন্দ্রকে ছেড়ে দিলে প্রান্তের তো কোন অস্তিত্বই থাকে না। অন্ত্যজ মানে অন্তে জন্ম যার, আর প্রান্তিক মানে প্রান্তে যার অবস্থান। যে প্রতিনিয়ত জন্মায় সে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়, বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে এগোতে থাকে - স্পাইরাল মোশন। কেন্দ্রের অভিমুখী ও কেন্দ্রের বিপরীত শক্তির টানে প্রান্তের দোলাচল অন্ত্যজদের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। সেই অন্ত্যজ ও প্রান্তিক মিলে যে অবয়ব নির্মিত হয় তাকেই এই নিবন্ধে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কেন্দ্র - প্রান্ত সম্পর্কের মর্মবেদনা,আবার অন্ত্যজদের সাধারণ মনোবেদনা – এই দু’য়ের যে জটিল আন্তঃসম্পর্ক সাংস্কৃতিক অবয়বকে নির্মিত করে এবং প্রতিনিয়ত ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে তার স্বরূপ বোঝার প্রচেষ্টা করা হয়েছে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।

একটি শোষণমূলক অসম সমাজে সংস্কৃতি আসলে মনোবেদনারই প্রকাশ। বেদনা মানে কি শুধু নিপীড়িতের কান্না,আমোদ আহ্লাদ নয়? আমোদের একটি গালভরা নাম আছে, যাকে বলা হয় “এন্টারটেইনমেন্ট"। সেটার একটা গূঢ় অর্থ বোঝা যেত, যদি সংস্কৃতি মানে "এন্টারটেইনমেন্ট" - আত্মতৃপ্তির এরকম প্রকাশে গোটা বিষয়টাকে হাস্যাস্পদ করে তোলা না হতো। নির্জন নিভৃত ঘরের কোণে দুঃখ বেদনার অনুভূতির যৌথ প্রকাশই হচ্ছে সামাজিক বা শ্রেণি সংস্কৃতি, বরাকের অন্ত্যজ শ্রেণির সংস্কৃতিও সেরকম কিছু অবসর বিনোদন আবার একই সাথে জীবন সংগ্রাম এবং সেজন্যই সামূহীক দুঃখ বেদনায় জারিত সেই সংস্কৃতি চর্চায় আমোদ ও বিমর্ষতা, আত্মসমর্পণ ও বিদ্রোহ পরস্পর সম্পৃক্ত -- সামগ্রীকভাবে সেটাই মনোরঞ্জন। 

 সংস্কৃতির সংজ্ঞা হচ্ছে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি ছাড়া বাকী সবকিছুর দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের গতির অভ্যন্তরে মনোরঞ্জন। সেই গতি যখন খুবই মন্থর, তখন পরলৌকিক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সংস্কৃতি চর্চায় নিহিত থাকে ধর্মীয় প্রাধাণ্য। এই মন্থরতার কারণ নিহিত এমন এক গ্রাম সমাজে যেখানে জমি-ভিটে গৃহস্থালিকে কেন্দ্র করে জীবন অতিবাহিত। বরাক উপত্যকার কিছু কিছু সীমিত অঞ্চলের জনজাতীয় সমাজ ও চা-বাগানকে বাদ দিলে, সমগ্র বরাক জুড়ে প্রতিটি বাঙালি সম্প্রদায়ের ছিল বিভিন্ন সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত সমাজ পরিচালনার একেকটি কাঠামো,এই কাঠামোর শির্ষে বসে থাকতেন নিজ সমাজের শ্রমের উদ্বৃত্ত আহরণকারী মাতব্বরেরা। সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলার স্বার্থে সমাজের সদস্যরা মাতব্বরদের সেই ক্ষমতা স্বেচ্ছায় প্রদান করত । কিন্তু চাষাবাদের পন্থা পদ্ধতি ও উৎপাদনী শ্রম-চক্রের সাথে যুক্ত সামাজিক ভাবাবেগ যে আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্তি ঘটে তাকে শ্রম-শোষণকে মেনে নেওয়ার গণ্ডীতে বেঁধে রাখতে ধর্মীয় নিয়মাবলীর নিয়ন্ত্রক হিসাবে জাঁকিয়ে বসে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র । সম্প্রদায় হিসাবে শ্রম-বিভাজনের স্তরতন্ত্র ও পরজন্মের সুখ লাভে আত্মসমপর্ণের ধর্মীয় সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মূল আঁধার অর্থাৎ ধর্ম-সংস্কৃতি ও শাসন একই অঙ্গের দু’টি রূপ, একটি ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব নেই, দু’য়ের টিঁকে থাকা ও বিলোপ পরস্পর সম্পৃক্ত। কৃষিভিত্তিক বাঙালি মুসলিম সমাজ এর থেকে খানিকটা ভিন্ন। তাতে দু’টি ধারা বিদ্যমান। শক্তিশালী ধারাটি পীর ফকির আউলিয়াদের ইসলামের হাত ধরে স্থায়ী কৃষির মাধ্যমে বাঙালি হয়ে উঠেছিল, আরেকটি ধারা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র থেকে মুক্তি লাভের আশায় ধর্মান্তরিত হয়ে। ফলে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সমাজে গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চায় বিষয়বস্তুর মধ্যে বিশেষ কোন ফারাক নেই।বরাকের বিভিন্ন প্রান্তে বাদশা পূজা, নৌকা পূজা, ঈদ উৎসব ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক আনন্দোৎসব রয়েছে যেখানে অন্ত্যজ হিন্দু মুসলিম মিলেমিশে একাকার, তার অবশেষ এখনও বিদ্যমান। ধর্মের আঁধারে হিন্দুদের আত্মসমর্পণ ঈশ্বরে, মুসলমানদের আল্লায়। 

সেটা আত্মসমর্পণের দিক, সেটা আত্মস্থ হয়েছে শাসন ও শোষণ ব্যবস্থায়, কিন্তু সে কি তার মুক্তির কথা, সব বাধার প্রাচীর ভেঙে মানুষ হয়ে ওঠার কথা, মানুষে মানুষে প্রেম ভালবাসার কথা তার সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গীভূত করে নেয় না? যদি না নিত, তাহলে মনসা, চরক পূজার মত লোকায়ত পূজা পার্বণের গান, কীর্তন, ধামাইল, জারি শারি, শ্রমভিত্তিক লোকসঙ্গীত এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠত না। হাজারো উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায়, এগুলিতে যেমনি রয়েছে ধর্মীয় আত্মসমর্পণ, তেমনি রয়েছে মানুষ হয়ে ওঠার আকূতি, শোষণ মুক্তির প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা। 

ব্রিটিশ শাসনকালে ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে সাথে সামাজিক সংস্কৃতিতে এক নতুন দিকও সংযোজিত হয়। সেই পর্যায়কে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। সীমিত পরিসরের বাধ্যবাধকতাকে বিবেচনায় রেখে শুধু কয়েকটি দিক এখানে উল্লেখ করব। চা-বাগান পত্তন, রেল লাইন নির্মাণ, সমগ্র বরাক উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য চলাচলের নতুন কেন্দ্র গড়ে ওঠা, অবিভক্ত করিমগঞ্জ জেলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে নতুন রায়তওয়ারি ব্যবস্থা কায়েম, কাছাড় জেলা মূলত এস্টেট-ল্যাণ্ড হওয়ায় সরকারি মালিকানায় খাজনার মাধ্যমে শ্রমের উদ্বৃত্ত আহরণ ইত্যাদি সেই নতুন বৈশিষ্ট্যকে সংযোজিত করে। করিমগঞ্জ জেলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মুসলিম প্রজাদের উপর জমিদারি শোষকেও তীব্র করে এবং শোষিত ও শোষকের সামাজিক সেই সম্পর্কের অভ্যন্তরে বর্ণ-বিভাজনও কায়েম থাকে। নানকার কৃষক বিদ্রোহ থেকে শুরু করে একষট্টি ও ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনে সেই সম্পর্কের গতি প্রকৃতির প্রভাব ছিল। করিমগঞ্জ জেলার কৃষক বিদ্রোহের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া অনেক কবিগান, লোকগীতি এখনও অনুসন্ধান করলে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভাষা আন্দোলন সেই অর্থে লোকায়ত জীবন চর্চায় অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যে নতুন কোন সংস্কৃতির জন্ম দিতে ব্যার্থ হয়। সেটার কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি, হয়ত কোন গবেষক একাজটি করছেন। এই নিবন্ধে আমি শুধু তার মূল দিকটি সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

 ব্রিটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কিংবা শ্রমের উদ্বৃত্ত হিসাবে খাজনা আদায়ের পদ্ধতি যেমনি অন্ত্যজ শ্রেণি-বর্ণের শ্রম-শোষণকে তীব্র করেছে ও বরাক উপত্যকার নিজস্ব উন্নয়নের ও আধুনিক বিকাশের পথকে করেছে রুদ্ধ, ঠিক তেমনি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অনুপ্রবেশ নতুন সংস্কৃতির উন্মেষের জন্য প্রয়োজনীয় আধার হিসাবে দু'টি বাস্তব শক্তিকেও সীমিত পরিসরে জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এই দুই শক্তির জন্ম দিয়েছে দু'টি বিপরীত পথে। প্ল্যাবিয়ান বনাম প্যাট্রিসিয়ান বা অন্ত্যজ বনাম অভিজাত বিরোধ যেভাবে বরাকের গণসমাজের অভ্যন্তরে কৃষি সম্পর্কে নিহিত, ঠিক তেমনি পুঁজির অনুপ্রবেশ কৃষি থেকে মুক্ত এক মজুরি শ্রমিকের এক অন্ত্যজ শ্রেণি তৈরি করেছে পুঁজির নিজস্ব নির্মাণ ও পণ্য সঞ্চালনে শ্রমের অতি-শোষণের বাহিনী হিসাবে, বিপরীতে সমগ্র অভিজাত শ্রেণিটিই রয়ে গেছে ব্রিটিশ অফিসার ও তাদের ভারতীয় তাঁবেদার হিসাবে। অর্থাৎ অন্ত্যজ বনাম অভিজাতের দ্বন্দ্ব যুগপৎ ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময় মূল্যের উৎপাদনী কাঠামোয় নির্ধারিত হয় যার একদিকে রয়েছে কৃষক ও শ্রমিক এবং অন্যদিকে স্থানীয় শোষক, ব্রিটিশ আমলা ও তাদের শিক্ষিত তাঁবেদার – জাত-বর্ণ, গ্রাম-শহর বিভাজন তাতে অন্তর্নিহিত। কিন্তু পুঁজির অনুপ্রবেশ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম দেয় মানসিক শ্রমজীবীদেরও যাদের আমরা প্রচলিত বাকধারায় মধ্যবিত্ত হিসাবে চিহ্নিত করি। আর এরাই ছিল বরাক, এমনকি ভারতের বাইরে থেকে আমদানিকৃত বিলাসী সামগ্রীর উপভোক্তা। অর্থাৎ নিজস্ব শিল্প বিকাশের মাধ্যমে মজুরি শ্রমিক ও মানসিক শ্রমজীবীদের সৃষ্টি হয়নি, সৃষ্টি হয়েছে শ্রমের বিনিময় ও পণ্যের বিনিময়ের দু’টি আলাদা পথে বরাকের উদ্বৃত্ত মূল্য বেশি বেশি করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার গর্ভে। 

 স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সেই কাঠামোর আমূল কোন পরিবর্তন হয়নি, গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সামাজিক সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলেও, কায়িক ও মানসিক শ্রমের দু'টি পৃথক মেরুতে বরাকের শ্রমের মূল্যের বহির্গমণের কাঠামো আরও সুদৃঢ় হয়েছে। তদানীন্তন পূববাংলার প্রসারিত ভূগোল এই বরাক ভূমিতে দেশভাগের বলি হয়ে যে প্রব্রজিত মানুষ এসেছে তারাও এই দুই ভাগে পরস্পরকে আলাদা করে অন্ত্যজ ও প্রান্তিক সমাজের অঙ্গ হয়ে ওঠেছে। দেশভাগের পরিণতিতে বরাকের আরবান-স্পেস যেভাবে উদ্বাস্তুদের আপাত দখলে চলে যায় তারও এক নির্দ্দিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে, সেই সংস্কৃতিতে স্থানীয় - রিফিউজি টানাপোড়েন একটি নির্দ্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হলেও সেটা কোনওভাবে প্রান্তিকতার পরিণতির পুঁজির মূল গতি পথ থেকে আলাদা নয়, সেই গতি পথে এই টানাপোড়েন দ্রবীভূত হতে যে বিশেষ সময় নেয়নি, আশির দশক পরবর্তী এই উপত্যকার বিকাশের গতি পথ তা প্রমাণ করে।নব্য বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী লুণ্ঠনের স্বাভাবিক পরিণতিতে গ্রাম ছেড়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা শহরগুলিতে এসে আস্তানা গাঁড়তে শুরু করায় আরবান-স্পেসের উদ্বাস্তু আধিপত্যের বাস্তবতা বহুলাংশেই বিলীন হতে শুরু করে, নাগরিক জীবনে এই দ্বন্দ্ব আরও মিটে যাওয়ার কারণ নিহিত রয়েছে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের একাংশের বরাক ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতার মধ্যে - বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে শহরগুলির বাজারের নিয়মে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির আর বিশেষ অবশেষ বাকী না থাকায়। 

 ঊনিশ শতিকার ষাটের দশকে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যখন গভীর সংকটে প্রবেশ করে কিংবা তার থেকে বেরিয়ে আসার মরিয়া প্রচেষ্টা হিসাবে আশির দশকে নয়া-উদারবাদী পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন ভারতীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীকতা ও তার পরিপূরক অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের রাজনীতির বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে একষট্টির বা ছিয়াশির ভাষা আন্দোলন নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিতে ব্যার্থ হয়। এই দীর্ঘ পর্যায়ের সংস্কৃতি চর্চা বিচার বিশ্লেষণ করলে অবধারিতভাবে দু'টি সমান্তরাল ধারা ধরা পড়বে। এই গোটা পর্যায় জুড়ে গ্রামীণ কৃষি সম্পর্কে জমি ও ধর্মকেন্দ্রীক সংস্কৃতি চর্চা এবং সেই জীবন অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া কৃষকবিদ্রোহের চেতনায় সঞ্চারিত সংস্কৃতি চর্চা তার আবেদন হারাতে থাকে। জমির মালিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন যে মজুরি শ্রমিকশ্রেণির জন্ম তাদের মধ্যে একদিকে বিকৃত বাজারি সংস্কৃতি, অন্যদিকে সীমিত বামপন্থী উদ্যোগকে কেন্দ্র করে এক সচেতন সংস্কৃতি চর্চার জন্ম নেয়। সাংস্কৃতিক চেতনা জনজীবনের যাপনের অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ এবং সেজন্যই সংস্কৃতি চর্চার অনুসন্ধান করে আমরা জনজীবনের চেতনার মান বুঝতে পারি। আমরা যাকে শ্রেণি বলি, সেই শ্রেণি আসলে একেকটি জনসমাজের অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তব উপলব্ধির সামূহীক বহিঃপ্রকাশ, সত্তা ও তার হয়ে ওঠা, সেজন্যই শ্রেণি হয়ে ওঠা মানে শ্রেণিসংগ্রাম, সংস্কৃতি তার বহিরঙ্গের রূপ। এই গোটা পর্যায় জুড়ে অন্ত্যজদের শ্রেণি হয়ে ওঠার বামপন্থী সংস্কৃতির সেরকম একটি রূপ যখন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, ঠিক সেই সময় শহুরে মধ্যবিত্ত বা মানসিক শ্রমজীবীরা ভাষা আন্দোলনের প্রগতিশীল ধারায় গান, কবিতা, গল্প, নাটক ইত্যাদি সামগ্রীক সংস্কৃতি চর্চা করেছেন। কিন্তু এই দু'টি ধারা এক বিন্দুতে মিলে যাওয়ার কোন অবকাশ ঘটেনি, অবকাশ ঘটেনি কারণ শ্রমজীবীদের এই দুই রূপের জন্ম বরাক উপত্যকার নিজস্ব শিল্পায়নের পথে ঘটেনি, ঘটেছে উভয়ের শ্রমের মূল্যকে লুটে নেওয়ার দুই পৃথক পথে, সেজন্য বরাকের নতুন সাংস্কৃতিক চর্চার জন্ম বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রয়েছে তার প্রান্তিক অবস্থানের মধ্যে। 

 শ্রমের মূল্যের মুনাফা হিসাবে উন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশে গমন ব্রিটিশ ভারত বা স্বাধীন ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলেও, বিশ্ব পুঁজির সঙ্কটকালে বিলাস-সামগ্রীর উপভোক্তা হিসাবে মধ্যবিত্তের চাহিদা পূরণের শর্তে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নিজস্ব উৎপাদনী শিল্পায়নের প্রক্রিয়া গড়ে উঠলেও, বরাক উপত্যকায় সেরকম কিছু ঘটেনি।সমগ্র ভারতেই অন্ত্যজদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদার ভিত্তিতে শিল্পায়ন হয়নি, হয়েছে রপ্তানীনির্ভর অর্থনীতির সূত্র ধরে সাম্রাজ্যবাদী উন্নত দেশের ভোগ্যসামগ্রীর বাজারের চাহিদা মেটাতে সস্তায় বাণিজ্যিক-ফসলের যোগান ধরতে উৎপাদন ও প্রসেসিং-এ’র জন্য অন্ত্যজদের অতি-শোষণের শিল্পায়ন, বরাকে সেরকম কোন কিছুও গড়ে অঠেনি। বরঞ্চ অন্ত্যজ শ্রেণির ভোগ্য সামগ্রীর চাহিদা ব্যবহৃত হয় বরাকের বাইরে থেকে আমদানীকৃত শিল্পজাত ভোগ্য সামগ্রীর বাজার হিসাবে। ফলে পরনির্ভর ভারতের অঙ্গরাজ্য অসমের প্রান্তিক অঞ্চল বরাক তার প্রান্তিকতাকে আরও গভীর করে তোলে -- দেশ ও রাজ্যের সামগ্রীক পরিকাঠামোগত উন্নয়নের আবর্তে পণ্য সঞ্চালনের লক্ষ্যে বরাক উপত্যকার ভৌগলিক অবয়বের চোখধাঁধানো রূপান্তর সামজিক উন্নয়নের প্রান্তিকতাকে আপাতদৃষ্টিতে ধোঁয়াটে করে রেখেছে। কায়িক ও মানসিক শ্রমের দূরত্ব যত গভীর হয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উন্নয়নের ধারণা আত্মনিমগ্ন হয় প্রকৃত উৎপাদনী ও সামাজিক উন্নয়নের বদলে কর্পোরেট পুঁজির পণ্য চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো উন্নয়নে। কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাসত্বের প্রতিভূ হিসাবে হাজির হয় মধ্যবিত্তের সামূহীক বাজারি সংস্কৃতি চর্চা; ধর্মও সেখানে জমি, প্রকৃতি ও গ্রাম সমাজের আকর্ষণ ছেড়ে বাজারি সংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করে।  অন্যদিকে অন্ত্যজ শ্রেণিও জমি, প্রকৃতি ও গ্রাম সমাজের বাঁধন ছিন্ন করে বেশি বেশি করে পরিযায়ী ও কৃষি শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়েছে। কৃষি শ্রমিকের রূপান্তরণ ঘটেছে কৃষিতে আধুনিক উৎপাদনী উপকরণ, সিলিং অ্যাক্টের মাধ্যমে পুরোনো জমিদারি প্রথার অবসান ও পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে জমির কেন্দ্রীভবন, ফিনান্স পুঁজির মাধ্যমে পুরোনো মহাজনী প্রথার প্রতিস্থাপন, ক্যাশ ক্রপের প্রতি ও ভাগচাষের বদলে ঠিকা প্রথায় ঝোঁক এবং সর্বোপরি আমদানীকৃত ভোগ্য পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় কৃষি অলাভজনক হয়ে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জমি থেকে উচ্ছেদ। কর্পোরেট পুঁজি পরিচালিত সেরকম পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মজুরি শ্রমিকেরা আকর্ষণ হারাচ্ছে লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চার পুরোনো বিষয়ের প্রতি। সংস্কৃতি চর্চার যে ফর্মগুলি বরাকের গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয় ছিল, নতুন সমাজ বাস্তবতায় নতুন বিষয় চর্চার অভাবে সেই ফর্মগুলির এক বকচ্ছপ বাজারি রূপ পরিগ্রহ করছে। 

কিন্তু অন্ত্যজদের জীবন অভিজ্ঞতা বলছে যে তাদের পুরোনো জীবনের যে সুস্থিরতা ছিল, অফুরন্ত অবসর সময়ে বিনোদনের সুযোগ সহ জীবন যাপনের যে মান ছিল তার অবনমন ঘটছে। চোখের সামনে প্রাচুর্যের পাহাড় যা সে আগে ঘরের কোণে দিনাতিপাত করে দেখতে পেত না, এখন সে সর্বত্র বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রামে ঘুরে ঘুরে দেখতে পাচ্ছে। তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পৃথিবী তার গ্রামের বাসভূমি ছেড়ে ভারতব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়েছে। বরাকের প্রান্তিকতায় নির্ধারিত তার চূড়ান্ত শ্রম শোষণের ও শ্রমশক্তির মূল্যের নিচে কঠোর শ্রম করতে যে বাধ্য হচ্ছে, তার নিয়ম সে আবিষ্কার করছে ভারতব্যাপী আয়োজনে অন্যান্য প্রান্তিক ও অন্ত্যজদের সাথে আন্ত:ক্রিয়ার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে। সেজন্যই সে এক নতুন ভারত চায়, আর সেই চাওয়ার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে তথাকথিত নতুন ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি। সোনার অসম গড়ার অসম আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি কৃষকদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল সংখ্যালঘুর জমি জবরদখল করার লোভ দিয়ে। হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি নতুন অন্ত্যজদের লোভ দেখাছে প্রাচুর্যের,এক নতুন ভারত যেখানে যে যত বেশি শ্রম করবে - দিবারাতি কঠোর শ্রমে অন্যকে পেছনে ফেলে দেবে সে তত বেশি স্বপ্নের ভারত, প্রাচুর্যের ভারতের সদস্য হয়ে ওঠবে, পেছনে ফেলে দেওয়ার জন্য রয়েছে এক অপর যারা ধর্মসংস্কৃতিতে ভিন্ন। গ্রামীণ ধর্মীয় অতীতের আধুনিক পুনর্নির্মাণ সাংস্কৃতিকভাবে মোহগ্রস্ত করার অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।ভেঙে পড়া পুরোনো সামাজিক সম্পর্কের গর্ভেই হিন্দুত্বের এই পুনর্নির্মাণ, বরাকের গ্রামীণ সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চার এই ভাঙন প্রক্রিয়ার দিকে তাকালেই তা নজরে পড়ে। যে বৃহৎ বদরপুর অঞ্চলে নৌকা পূজা ও ঈদ-উৎসব ছিল অন্ত্যজ হিন্দু মুসলমান সমাজের সামূহিক আনন্দোৎসব তা দুই মেরুতে ভাগ হয়ে আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে, সেই ফাটল দিয়েই রামমন্দির আন্দোলনের অনুপ্রবেশ, পুরোনো সামাজিক সম্পর্ক যখন ভেঙে পড়ার মুখে পরে, নতুন তাকে প্রতিস্থাপিত করে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই নতুন দেখা দিয়েছে পুরোনো প্রতিক্রিয়াশীলতার পুনর্নির্মাণে – ঐক্যের সাংস্কৃতিক ধারার পুনর্নির্মাণের বিপরীতে বিভাজনের ধারার পুনর্নির্মাণে। যাপনের এই সংস্কৃতি শুধু হিন্দুত্ববাদের সংস্কৃতি নয়, কর্পোরেট পুঁজিরও সংস্কৃতি, কারণ এই মোহগ্রস্ততার অন্তরালে রয়েছে বেশি বেশি কঠোর ও গভীর সস্তা শ্রমের যোগানের আয়োজন, সেখানে অবসর বিনোদনে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার কোন অবকাশ নেই, রয়েছে শুধু সমস্ত সময় জুড়ে বেঁচে থাকার ও প্রতিযোগিতার শ্রম -- যা পুঁজির অতি-মুনাফার গ্যারান্টি। 

 কিন্তু সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চা একমুখীন নয়, সাংস্কৃতিক মোহগ্রস্ততা জীবন অভিজ্ঞতার একটি বিকৃতি, সস্তা শ্রমের বিনিময়ে যে বাঁচার সংগ্রামের তীব্রতা তা ভাষায়, ভাবে, ভঙ্গিতে অন্ত্যজরা একে অপরের সাথে ভাগ করে নেয়; চলার পথে সেখানেই গড়ে ওঠে অতীত সংস্কৃতি চর্চার রূপ ও বিষয়ের পুনর্ণির্মাণ, অন্ত্যজরা হয়ে ওঠে বিদ্রোহী, জন্ম দেয় প্রগতিশীল সংস্কৃতির, সেটা এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, দিকে দিকে সেরকম ঘটে চলেছে, বরাকেও তা ঘটবে। 

 সংস্কৃতির সেই হয়ে ওঠা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ হয়ে শুকিয়ে যাবে, না প্রবাহমান ফল্গুধারায় সমগ্র চরাচরকে গ্রাস করে নেবে শ্রমজীবীদের এক নতুন ভারত, নতুন অসম ও নতুন বরাকের দিকে, তা নির্ভর করবে মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত আলোকপ্রাপ্ত মধ্যবিত্তের ভূমিকার উপর। মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক চর্চা প্রগতিশীলতার একটি সংজ্ঞা খুঁজে বেড়ায়, সে নিজেদের পরিসর থেকে নির্মাণ করে নেয় সংস্কৃতির পূর্ব-নির্ধারিত বিষয় ও রূপ। অন্ত্যজ শ্রেণির ও শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণির যে দূরত্বের গভীরতা নির্মিত হয়েছে প্রান্তিকতার এক ব্যবস্থার গর্ভে তাতে এভাবে চাপিয়ে দিয়ে কোন সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নির্মাণ হয় না। অন্ত্যজরা তার অভিজ্ঞতা দিয়ে যে ভারতকে দেখতে চাইছে, সেই ভারত ধূসর হয়ে আছে শিক্ষা ও আলোকপ্রাপ্তির অভাবে। মধ্যবিত্ত সাংস্কৃতিক চর্চায়ও এক নতুন ভারতকে দেখতে হবে যে ভারতে বরাকের প্রান্তিক অবস্থানের ব্যবস্থাগত যোগসূত্র ছিন্ন হয়; শিক্ষিত মানসিক শ্রমজীবীকে শুধু অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করলে চলে না, যদিও এক্ষেত্রেও জীবন অভিজ্ঞতাই মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু প্রান্তিক সমাজের সামাজিক সম্পর্কের আমূল পরিবর্তনে অন্ত্যজদের সাংস্কৃতিক মতাদর্শগত পথপ্রদর্শক হওয়ার ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক বাস্তব চর্চাই নির্ধারক ভূমিকা পালন করতে পারে।

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator